কুমারখালীর হাটে তিন ঘণ্টায় প্রায় ৪ কোটি টাকার লুঙ্গি কেনাবেচা
কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী শেরকান্দি কাপুড়িয়া হাটে মাত্র তিন ঘণ্টায় প্রায় ৪ কোটি টাকার গ্রে লুঙ্গি (প্রক্রিয়াজাতকরণের আগের লুঙ্গি) কেনাবেচার খবর পাওয়া গেছে।
শনিবার (৬ মে) সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এ লেনদেন করেন তাঁতি, মধ্যস্থতাকারী ফাঁড়িদার ও ব্যবসায়ীরা। এদিনে হাটে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার মোট লেনদেন করেন তারা।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ওই কাপুড়িয়া হাটের সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে। গতকালকের হাটে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তবে করোনার আগে এ লেনদেন ছিলো আরো কয়েকগুণ বেশি।
জানা গেছে, প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে গড়াই নদের কূল ঘেঁষে ১৮৬৯ সালে গড়ে ওঠে কুমারখালী পৌরসভা। তখন থেকেই শেরকান্দি এলাকায় শুরু হয়েছিল হাটের যাত্রা। কুমারখালীর অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিই হচ্ছে বয়নশিল্প। এটি মূলত তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এ হাটের অধিকাংশ মানুষই কুমারখালী ও খোকসা এলাকার। স্থানীয় মানুষই এখানে বেশি। তবে অনেক দূরদুরান্ত থেকেও লোক আসে এখানে ব্যবসা করতে। তাছাড়া ক্রেতারাও আসে দূরদুরান্ত থেকে। তাদের ভিড়ও বেশ। নিজেদের পছন্দ মতো এবং চাহিদা অনুযায়ী তারা কেনাকাটা করতে পারে। আবার পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও আসেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এ হাট। প্রতি হাটে কোটি কোটি টাকার গ্রে লুঙ্গির ব্যবসা হয়।
আরো জানা গেছে, করোনার সময় লকডাউনে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন বন্ধ ছিল। সেসময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হাটের ঐতিহ্য হারিয়েছে। ট্রেনে যোগাযোগ ও পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা থাকায় এখন জেলার পোড়াদহতে জমজমাট হাট লাগে। করোনার আগে শেরকান্দিতে প্রতি হাটে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার কেনাবেচা হতো।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কাপুড়িয়া হাটে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রে লুঙ্গি কেনাবেচার জন্য টিনশেডের একটি পাকা ঘর নির্মাণ করা রয়েছে। সেখান হাজার হাজার তাঁতি, মধ্যস্থতাকারী ফাঁড়িদার, হকার, ব্যবসায়ী, দর্শনার্থীদের আনাগোনায় পা ফেলার জায়গা নেই। কেউ লুঙ্গি সাজিয়ে বসেছেন বিক্রির জন্য। কেউ বা কিনছেন। এছাড়াও টিনশেড ঘরের চারিদিকে ছোট ছোট ঘর রয়েছে। সেখানেও চলছে কেনাবেচা। এদিন হাটে মান ও আকারভেদে প্রতি থান লুঙ্গি ৬৫০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকায় বেচাকেনা হয়। এক থান সমান ৪ পিস লুঙ্গি।
এসময় কথা হয় তাঁতি মো. মোক্তার হোসেনের (৩৫) সাথে। তিনি কুমারখালী সদকী ইউনিয়নের উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, গ্রামে তার প্রায় ২০০ খানা আধুনিক তাঁত (পাওয়ার লুম) রয়েছে। শনিবার তিনি এক হাজার ৬০ টাকা দরে এক হাজার ৫০০ থান লুঙ্গি মোট ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। তার ভাষ্য, তিনিই এখন ওই হাটের বড় তাঁতি। প্রতি হাটে তিনি ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার গ্রে লুঙ্গি বিক্রি করেন। আর প্রতি হাটে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার লুঙ্গি কেনাবেচা হয়।
আরেক তাঁতি এবং তার চাচাতো ভাই রুহুল আমিন জানান, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা এ হাটে আসেন। তিনি শনিবারের হাটে এক হাজার থান লুঙ্গি বিভিন্ন দরে প্রায় দশ লাখ ৩৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। তার ভাষ্য, করোনার আগে বেচাবিক্রি আরো বেশি হতো।
এদিন হাটে আসা ঘাসখাল এলাকার মাঝারি তাঁতি এনামুল হক বলেন, আকার ও মান ভেদে ৬৫০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকা করে প্রতি থান লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে। তিনি শনিবারের হাটে ৬০০ থান লুঙ্গি বিক্রি করেছেন।
চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা গ্রাম থেকে হাটে আসা তাঁতি আব্দুল লতিফ বলেন, চাল, ডাল, তেল, রং- সুতার দাম বেড়েছে অনেকগুণ। কিন্তু সেই তুলনায় লুঙ্গির দাম বাড়েনি। তিনি ৮০০ টাকা দরে ৫০ থান লুঙ্গি ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।
মিল্টন হোসেন নামের একজন লুঙ্গি বিক্রেতা বলেন, তিনি পাবনার শাহাজাতপুর এলাকা থেকে লুঙ্গি কিনে এনে কুমারখালী হাটে বিক্রি করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে হকাররা হাটে এসে তার কাছ থেকে লুঙ্গি কিনে নিয়ে যান। এ হাটে তিনি এক লাখ ৩০ হাজার টাকার বেচাকেনা করেছেন।
ফাঁড়িদার রাজু আহমেদ বলেন, হাটে বাইরের জেলা থেকে আগত পার্টিদের (ব্যবসায়ী) মালামাল কিনে দেন তিনি। প্রতি হাটে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মাল কিনে দেন তিনি। তবে ঈদের পরে লুঙ্গির দাম উঠানামা করায় তিনি এ হাটে কোনো পার্টি পাননি, মালও কিনেননি।
চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী রায়হান উদ্দিন বলেন, ৭২০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত দরে তিনি এক লাখ ৬০ হাজার টাকার পণ্য কিনেছেন। লিমন শেখ নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, তিনি বিভিন্ন দরে প্রায় ১৩ লাখ টাকার লুঙ্গি কিনেছেন। এসএ পরিবহনে করে তিনি মাল নিয়ে যান বিক্রয়স্থলে।
কুমারখালী তাঁতবোর্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মেহেদী হাসান বলেন, উপজেলায় প্রায় সাত হাজার তাঁতি রয়েছে। প্রতি হাটে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। কিন্তু করোনার আগে লেনদেন আরো বেশি ছিল। তবে আবার ভাল ব্যবসা শুরু হয়েছে। তাঁতিদের ভাগ্যবদলে কাজ করছে তাঁতবোর্ড।