‘লাল’ ছাপিয়ে আবারও ‘কমলায়’ ফিরছে জাহাজ ভাঙা শিল্প
চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্পে 'লাল' ও 'কমলা' রঙের লড়াই চলছে গত ২৬ বছর ধরে। পরিবেশের তদারককারী সংস্থার এই আইনি সংকেতে জাহাজ ভাঙার অনুমতি পেতে কখনও হয়রানি বেড়েছে, আবার কখনও কমেছে। জাহাজ আমদানি করে কাটার আগে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে লাল কিংবা কমলা শ্রেণির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
লাল শ্রেণি হচ্ছে পরিবেশের জন্য অতিঝুঁকিপূর্ণ ও কমলা শ্রেণি কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে লাল শ্রেণিতে থাকা জাহাজ ভাঙা শিল্প আবারও কমলা শ্রেণিতে ফেরার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সম্প্রতি জারি করা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এ শিল্পটিকে লাল শ্রেণিভুক্ত করার পর ব্যবসায়ীরা তা প্রত্যাহারে তৎপর হন। এরই অংশ হিসেবে জাহাজ ভাঙা শিল্পকে 'কমলা-খ' শ্রেণিতে রাখার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া অধিশাখা থেকে। ১৫ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোমিনুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে এই নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন অফিস থেকে পাওয়া এই চিঠি থেকে জানা গেছে, জাহাজ ভাঙা শিল্পকে প্রথম ১৯৯৭ সালে কমলা-খ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে আনা হয় 'লাল' শ্রেণিতে। দেশে-বিদেশে এই নিয়ে প্রভাব পড়লে ২০২০ সালে আবার এই শিল্পকে আনা হয় কমলা-খ শ্রেণিতে।
চলতি বছর সর্বশেষ 'লাল' শ্রেণিতে নেওয়ার পর এই শিল্পের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জানিয়ে শিপ ব্রেকার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সভাপতি আবু তাহের বলেন, 'সম্প্রতি জাহাজ ভাঙা শিল্পকে অতিঝুঁকিপূর্ণ 'লাল' শ্রেণিভুক্ত করার পর আমরা তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করি। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এই নিয়ে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়টি দেশ ও ব্যবসার স্বার্থে ইতিবাচক।'
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার ধকল, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আমদানি কিছুটা বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে ৪ লাখ ৩২ হাজার ১৯৩ টন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। এর পরের চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৩৬৭ টন।
কিন্তু শ্রেণি জটিলতার কারণে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে ইয়ার্ডে আনার পরও ছাড়পত্র অনুমোদনে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। নতুন পরিবেশ আইনের কারণে ছাড়পত্র অনুমোদন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আইনে জাহাজ ভাঙা শিল্পকে 'লাল' তালিকাভুক্ত করায় কাটার আগে প্রতিটি জাহাজের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে দ্বিতীয় দফা পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা আছে। এতে সময়ক্ষেপণ, আর্থিক ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। আর 'কমলা' শ্রেণিতে হয়রানি ও সময়ক্ষেপণ অনেক কম।
এই অবস্থায় পরিবেশ সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিবেচনা করে এই শিল্পে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার স্বার্থে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোমিনুর রশীদ জাহাজ ভাঙা শিল্পকে কমলা-খ শ্রেণিভুক্ত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের (জেলা) উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, 'পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে লাল ও কমলা শ্রেণিভুক্ত হয় বিভিন্ন শিল্প। জাহাজ ভাঙা শিল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই। যেহেতু জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে নতুন নির্দেশনা এসেছে, আমরাও সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।'
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) তথ্যমতে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে ১৬০টি শিপ ইয়ার্ড রয়েছে। এরমধ্যে ২০১২ সালের পর থেকে বন্ধ হতে হতে ২০১৯ সালে এসে ইয়ার্ডের সংখ্যা ৯০টিতে নেমে আসে। ২০১২ সালের পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উত্থান-পতন, চাহিদার চেয়ে বাড়তি আমদানি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আবাসন ব্যবসার মন্দায় লোকসানে পড়ে এসব ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়।
করোনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রায় ৩০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় আরও ৪০ ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২০ থেকে ২২টি ইয়ার্ড কোনোরকমে কার্যক্রম চালাচ্ছে।