মুদ্রা বিনিময় নয়, ভারতের সাথে বাণিজ্য হবে রুপিতে
গত কয়েক মাস ধরে টাকা-রুপি বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) ভিত্তিতে বাণিজ্যের আলোচনা চললেও – দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি অংশ শুধু রুপিতে নিষ্পত্তি করবে বাংলাদেশ ও ভারত।
এ বিষয়ে রাজি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংক ও ইষ্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে (ইবিএল) ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে রুপিতে নস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দিয়েছে।
এই দুই ব্যাংকে খোলা নষ্ট্রো-অ্যাকাউন্টে শুধুমাত্র (ভারতে) রপ্তানির বিপরীতে রুপিতে অর্জিত আয় জমা করা যাবে। জমা হওয়া অর্থে শুধুমাত্র ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য ও সেবার ব্যয় মেটানো যাবে।
এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে আগাম পরিশোধ করা যাবে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত গাইডলাইন মেনে এসব অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ওভার ড্রাফট ও স্বল্প মেয়াদি ঋণও নেওয়া যাবে।
সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল নস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন করেছে
সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল ইতোমধ্যে ভারতের ব্যাংকে নষ্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছে আবেদন করেছে বলে জানান বাংলাদেশি ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা।
কোনো ব্যাংক অপর কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুললে তাকে নস্ট্রো- অ্যাকাউন্ট বলা হয়। নস্ট্রো শব্দটি এসেছে ল্যাটিন থেকে, যার অর্থ 'আমাদের'। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও বাণিজ্যিক লেনদেনের সুবিধার্থে এধরনের অ্যাকাউন্টের ব্যবহৃত হয়।
এ বিষয়ে ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদেরকে ভারতের ব্যাংকে একটি নষ্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দিয়েছে। সে অনুযায়ী, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে (এসবিআই) হিসাব খোলার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) কাছে আবেদন করা হয়েছে।"
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সৃষ্ট ডলারের সংকটের মধ্যে কয়েক মাস ধরেই টাকা ও রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয়ে কথা হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য বা সেবা রুপিতে বিক্রি করবেন। একইভাবে ভারতের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে টাকায় বিক্রি করবেন।
এজন্য সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে এমন আলোচনা হয়েছিল। ভারতীয় ব্যাংক দুটিও বাংলাদেশি দুই ব্যাংকে একই ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। জানা গেছে, আলোচনার এক পর্যায়ে ভারতীয় পক্ষ শুধু রুপিতে লেনদেনের কথা বলে বলে, বাংলাদেশও তাতে সম্মতি দিয়েছে।
জুনের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার আশা কর্মকর্তাদের
ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী জুনের মধ্যে উভয় দেশের ব্যাংকগুলো এ ধরনের লেনদেনের জন্য প্রস্তুতি শেষ করতে পারবে। এরপর এর আওতায় এলসি খোলা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকগুলো এ দুই ব্যাংকের মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে লেনদেন করতে পারবে।
আলী রেজা ইফতেখার জানান, "শুরুর দিকে আমরা বলেছিলাম ভারতের ব্যাংক আমাদের ব্যাংকে ভস্ট্রো-অ্যাকাউন্ট খুলবে। কিন্তু, এখন ভারতীয় পক্ষ বলছে তার প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশে অ্যাকাউন্ট না খুলেও লেনদেন করা যাবে।"
বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে যখন বিদেশি কোনো ব্যাংক এ দেশের মুদ্রায় হিসাব খোলে তখন তাকে ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট বলা হয়। একইভাবে, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের বিদেশি ব্যাংকে খোলা হিসাব হলো নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট।
ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, "সোনালী ও ইবিএল পাইলট হিসেবে এই লেনদেন শুরু করবে। শুরুতেই অনেক লেনদেন সম্ভব হবে না। ধাপে ধাপে এগোতে হবে। বাংলাদেশের রপ্তানির বিপরীতে যতটা রুপি পাওয়া যাবে, ততটা আমদানি দায় রুপিতে পরিশোধ করা যাবে।"
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। আর ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছর ধরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সম্প্রতি টিবিএসকে জানিয়েছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কয়েক মাস আগে রুপিতে সরাসরি লেনদেন করার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে। "রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার এই সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ বিষয়টি পর্যালোচনা করে রুপিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে তাদের মুদ্রা রুপি ব্যবহারের মৌখিক প্রস্তাব দেয়। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে বলা হয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক - রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত বছরের ১১ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনে রুপিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানির সকল লেনদেন হবে রুপিতে। দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হার হবে বাজারভিত্তিক।
১৮ দেশের সাথে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ ভারতের
গত মার্চে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ-প্রতিমন্ত্রী ভাগবত কৃষ্ণরাও করাদ রাজ্যসভায় জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ১৮টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য রুপির মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করেছে আরবিআই। মালয়েশিয়ার সঙ্গে এই ব্যবস্থা এরমধ্যেই চালুও হয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির কদর বাড়াতে চায়। এজন্য শুধু বাংলাদেশ নয়, রাশিয়াসহ অন্য অনেক দেশের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে দেশটি।
তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এটি হলে রুপির ওপর নির্ভরতা তৈরি হবে। তাছাড়া, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। তাই রুপিতে লেনদেনে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ী, ব্যাংকাররাও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন
একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বলা হচ্ছে বাংলাদেশ যতটা রপ্তানি করবে ততটাই রুপিতে লেনদেন হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা যাবে ভারতের ব্যাংক রুপি ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় এলসি নিচ্ছে না। তখন ডলার দিয়ে রুপি কিনতে হবে এবং সেক্ষেত্রে বিনিময় হারে লোকসানে পড়তে হতে পারে।
একজন ব্যাংকারও এমন মনে করেন। তিনি বলেন, ভারতে যে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার কাঁচামাল আমদানি হয় অন্য দেশ থেকে। "রুপিতে রপ্তানি করে রপ্তানিকারক কাঁচামাল আমদানির জন্য অর্থ কোথায় পাবে? দেশে ডলার দিয়ে রুপি কেনার ব্যাংকও পাওয়া যাবে কিনা- তাতে সংশয় রয়েছে। ফলে এ ধরনের উদ্যোগে সফলতা পেতে সময় লাগবে। ভারতে রপ্তানি বাড়তে হবে।"
বেশ কিছুদিন ধরেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি নিয়ে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, কারেন্সি সোয়াপ (মুদ্রা অদল-বদল) ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে আলোচনা হচ্ছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নভুক্ত (আকু) দেশগুলো নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি দায় পরিশোধের আলোচনা করছে।
গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এলসি খোলার অনুমোদন দিয়েছে। উত্তরা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের এলসি খুলেছেও। রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশ ডলার সংকটে পড়েছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ভারতও চাচ্ছে তাদের মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন বাড়াতে।
ব্রিকসভুক্ত দেশ—ভারত, রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাও ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি শুরুর বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। সৌদি আরবও ইউয়ানে চীনের কাছে জ্বালানি তেল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সতর্কতার সাথে এগোনোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
গবেষণা সংস্থা- সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, "বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটময় পরিস্থিতিতে ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় লেনদেনের উদ্যোগটি ঠিক আছে। আর ভারতের মত বড় বাণিজ্যিক অংশীদার দেশের সঙ্গে সেটি করা গেলে আরও ভালো। তবে দেখতে হবে সেটা বাংলাদেশের জন্য কতটা বাস্তবসম্মত। কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ভারতে ২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করছে।"
"ফলে ভারত থেকে আমদানি দায়ের পুরোটা রুপিতে পরিশোধ করতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী বা ব্যাংক পর্যাপ্ত রুপি কোথায় পাবে? যদি ডলার দিয়ে রুপি কিনতে হয়, তাহলে সেটা করার আগে বার বার পর্যালোচনা করা দরকার। অন্যদিকে ভারতের মুদ্রা আন্তর্জাতিকভাবে কনভার্টেবল কারেন্সি নয়। যেকারণে ভারতে রপ্তানির বিপরীতে যে রুপি পাওয়া যাবে- সেগুলো অন্য কোনো দেশের দায় মেটানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে না।"
তিনি বলেন, এজন্য ততটাই রুপিতে লেনদেন করা ঠিক হবে, যতটা রুপি বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি আয় বাবদ পাবে। বাংলাদেশের অর্জিত রুপি দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা গেলে, সেটা ডলারের ওপর থেকে চাপ কিছুটা কমাবে।