সংগ্রামের পথ পেরিয়ে স্বপ্নের ভুবনে শাহাদাত
মানুষের জীবন কতোটা বৈচিত্র্যপূর্ণ? কিংবা কতোটা সংগ্রাম শেষে মেলে সাফল্যের ছোঁয়া? শাহাদাত হোসেন দিপুর জীবনগল্প শুনলে উত্তর মিলতে পারে। ২১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের জীবনযুদ্ধ আর সবার চেয়ে যেন একটু বেশিই কঠিন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাড়িচালক শাহাদাতের বাবা আবদুস সবুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালে মারা যান। দুই ছেলে আবুল হোসেন ও শাহাদাতকে নিয়ে ঘোর অন্ধকারে পড়ে যান মা ফেরদৌস বেগম। সংসার চালাতে বাবার জায়গায় গাড়িচালকের চাকরি নেন আবুল।
আবুল যখন সংসার চালাতে রাতদিন এক করে ফেলছেন, শাহাদাত তখন ছুটছেন ক্রিকেটের পেছনে। এই স্বপ্নেও বাধা পড়ে ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া শাহাদাতের। বিকেএসপির ট্রায়াল থেকে বাদ পড়েন তিনি। শাহাদাত যখন হার মেনে নেবেন, এমন সময় সুদীপ্ত দেব নামের একজন শাদাহাতের মা ও বড় ভাইকে বুঝিয়ে তাকে ইস্পাহানি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ২০১৩ সালে দলটির হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলেন মিডল অর্ডার এই ব্যাটসম্যান।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম জেলা দলে সুযোগ হয় শাহাদাতের। এখান থেকেই বদলাতে থাকে তার গল্প। অভাবকে হার মানিয়ে ক্রিকেট খেলা যাওয়া শাহাদাত জায়গা পেয়ে যান যুব বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলে। যুবাদের বিশ্বজয়ের মিশনে তিনিও একজন গর্বিত সদস্য। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেট, 'এ' দল পেরিয়ে স্বপ্নের ভুবন জাতীয় দলে শাহাদাত। আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে জাতীয় দলে অভিষেক হয়ে যেতে পারে মিডল অর্ডার এই ব্যাটসম্যানের।
এতো সংগ্রামের পর লক্ষ্যের দরজায় পা ফেলে কেমন লাগছে? উচ্ছ্বাসের শেষ নেই তরুণ এই ক্রিকেটারের। স্বপ্নের দুয়ারে পা ফেলে ভালো লাগার অনুভূতির কথা জানিয়েছেন তিনি। তবে একই সঙ্গে মনে রাখছেন ধাপে ধাপে নিজেকে আরও শানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটিও, 'খুশি তো লাগবে, এটা স্বাভাবিক। সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার, আমারও একই। প্রতিনিয়ত আরও যেন উন্নতি করতে পারি,, সেটাই চিন্তা করছি।'
স্বপ্নপূরণের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা শাহাদাতের কাছে তার সংগ্রামের দিনগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছুটা আবেগী কণ্ঠে তিনি বলে গেলেন, 'আমার বাবা যখন মারা গেছেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। ওইরকমভাবে বুঝতে পারিনি বিষয়টা। আস্তে আস্তে যখন বড় হচ্ছিলাম, আমার বড় ভাই আমাকে সাহায্য করছিলেন। এবং সুদীপ্ত ভাই ছিল, সে ক্রিকেটে অনেক হেল্প করেছেন। জিনিসপত্র থেকে শুরু করে সবকিছু দিয়েছেন। ওখান থেকে আস্তে ধীরে এগোনো।'
বিশ্বজয়ী যুব দলের অনেকেই জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন। শাহাদাতের সেই ধারায় থাকা হয়নি। দারুণ সম্ভাবনাময় হলেও প্রত্যাশিত গতিতে স্বপ্নের দিকে এগোনো হয়নি তার। ঘরোয়া ক্রিকেটে সামর্থ্যের ছাপ রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু ছিল না ধারাবাহিকতা। ২০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২টি সেঞ্চুরি ও ১০টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৬.১৪ গড়ে ১ হাজার ২৬৫ রান করেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
লাল বলে সর্বশেষ ঘরোয়া মৌসুমেও মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি শাহাদাত। জাতীয় লিগে ৬ ইনিংসে ১১৫ ও বিসিএলে ৫ ইনিংসে ২ হাফ সেঞ্চুরিতে করেন ১৯৪ রান। টেস্ট দলে তার জায়গা হয়েছে মূলত 'এ' দলের হয়ে করা পারফরম্যান্সে। গত ডিসেম্বরে ভারত 'এ' দলের বিপক্ষে সিলেটে ৮০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। কদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ 'এ' দলের বিপক্ষে সিলেটেই দ্বিতীয় আনঅফিসিয়াল টেস্টে ৭৩ ও ৫০ রানের কার্যকর দুটি ইনিংস খেলেন শাহাদাত।
'এ' দলের হয়ে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন তরুণ এই ব্যাটসম্যান। মনে মনে জাতীয় দলের হয়ে খেলার রঙিন স্বপ্ন বুনে গেলেও প্রত্যাশার ঘুড়িতে লাগাম রেখেছিলেন, 'আমি 'এ' দলে খেলছিলাম। তিনটা ম্যাচ ছিল ওখানে। এটা নিয়েই ফোকাসড ছিলাম, 'এ' টিমে ভালো করার। বাকিটা আমি জানতাম না, বা কী হবে না হবে। ওইরকমভাবে কিছু বলেননি (নির্বাচকরা)। নির্বাচিত হওয়ার পরে বাশার (হাবিবুল বাশার) স্যার কল দিয়েছিলেন।'
শাহাদাতের অনেক সতীর্থেরই জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে, কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন নিয়মিত সদস্য। তিনি অবশ্য এসব নিয়ে ভাবেননি, নিজেকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল তার মিশন, 'ওইসব ব্যাপার নিয়ে আমি কোনোদিন চিন্তা করিনি। চিন্তা করেছি, যখনই আমাকে ডাকবে, খেলার জন্য প্রস্তুত থাকব। অবস্থা অনুযায়ী যখন যেভাবে বলে, ওইভাবে খেলার চেষ্টা করি। যখন যেমন রকম অবস্থা থাকে, ওইভাবে খেলার চেষ্টা করি৷'
এই বয়সেই নিজের দক্ষতার প্রশংসা শোনেন শাহাদাত। তবে মানসিকভাবে নিজেকে আরও পরিণত করার তাগিদ অনুভব করেন তরুণ এই ক্রিকেটার। বুঝতে পারেন ঘরোয়া ও 'এ' দলের মধ্যকার পার্থক্যও, 'স্কিল ভালো, সেটা সবাই বলে। আর আসলে আমি অনুভব করি, মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এখানে খেলার জন্য।'
'ওদের ('এ' দল) বোলার একটু কঠিন থাকে অবশ্যই। ভালো অভিজ্ঞ থাকে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের থাকে, যারা 'এ' দলে খেলে। ভারতের মোটামুটি ভালো বোলাররাই খেলেছে। ওদের স্কিল খুব ভালো থাকে। ওরা একটু চ্যালেঞ্জিং থাকে। এই পর্যায়ে খেলতে মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী থাকতে হয় বলে আমার কাছে মনেহয়।' যোগ করেন শাহাদাত।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের জন্য ক্যাম্প শুরু হয়েছে বাংলাদেশের। ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন শাহাদাত। উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়াসহ বিসিবির ব্যাটিং পরামর্শক জেমি সিডন্সের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, 'সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। ভালো লাগছে যে, সবারই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলে খেলার। আমারও আছে। স্কিল অনুযায়ী স্পিনে কীভাবে খেলতে হবে বা পেস বোলিং কিভাবে খেলতে হবে, জেমির সঙ্গে কাজ করেছি। কিছু কিছু জিনিস কাজ করিয়েছেন। ওইগুলো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।'
অভিষেক হলে জাতীয় দলে থিতু হওয়ার লড়াইটা যে বেশ কঠিন হবে, তা জানা আছে শাহাদাতের। তাই দক্ষতায় প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করার পরিকল্পনা তার, 'আমি প্রতিদিন নিজের স্কিলটাকে উন্নত করার চেষ্টা করব। মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করব। এটাই আমার কাজ। যতো উন্নতি করব, আমার জন্য খেলাটা ততো সহজ হবে।'