শব্দ ছাড়া ‘নিউজপেপার’! আলমারিতে খোঁজ মিলল হারিয়ে যাওয়া সাময়িকীর
একটি শব্দও লেখা নেই। সামিয়কীর প্রতি পৃষ্ঠায় কেবল ছবি। প্রথম দুই সংখ্যায় নামও ছিল না। প্রচারণার উদ্যোগ ছাড়াই নিউইয়র্কে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাময়িকীটি। পরে নাম দেওয়া হয় 'নিউজপেপার'।
কিন্তু হঠাৎ একসময় যেন উধাও হয়ে যায় সাময়িকীটি। সংশ্লিষ্টদের কাছেও কোনো কপি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কয়েক যুগ পর এসে অনেকগুলো কপির সন্ধান মেলে এক আলমারিতে। জানা যায় প্রকাশের সময়কালের সাহসী সব চিত্রগ্রাহকদের কথা।
১৯৬৮ সালের মাঝামাঝিতে নিউইয়র্কের বোহেমিয়া নামক জায়গা থেকে এই সাময়িকী প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রথম দুই সংখ্যায় প্রকাশনার কোনো নামই ব্যবহার হয়নি। ছবিগুলো কার তোলা সে পরিচয়ও দেওয়া হতো না। রাজনৈতিকভাবে উগ্র ও অনেকের কাছে অশালীন মনে হতে পারা ছবি থাকায় এটিকে সাহসী প্রকাশনা বলে মন্তব্য করেন অনেকে।
মানুষের মুখে মুখেই 'নিউজপেপার'-এর প্রসার হতে থাকে। বিশেষ করে নাইটক্লাব আর ক্যানসাস সিটির মতো জায়গায় সাময়িকীটি বেশি প্রচারিত হয়। ওসব জায়গায় ম্যানহাটন থেকে অনেকে আসতেন আনন্দময় সময় কাটাতে।
দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন ফুট এবং প্রস্থে প্রায় দুই ফুটের ভাঁজ করা ট্যাবলয়েডটি পাঠকরা কোনো শিল্পকর্মের মতো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারতেন।
'নিউজপেপার'-এর সঙ্গে যুক্ত ৪৮ জন শিল্পীর দীর্ঘ তালিকা পাওয়া গেছে। সাময়িকীটির মাত্র ১৪ টি সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল। অ্যান্ডি ওয়ারহল, ডায়ান আরবাস, রিচার্ড অ্যাভেডন, পিটার বিয়ার্ড, পিটার হুজার, ক্রিস্টো, জাঁ ক্লদ, ইয়ায়োই কুসামা, পল থেক, রয় লিচেনস্টাইন, ডুয়ান মিকালস ও লুকাস সামারাসের ছবি এতে প্রকাশিত হয়েছে।
তৃতীয় সংখ্যাটি 'অর্ক' নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে সাময়িকীর সংখ্যা নম্বর বসানো হয় এবং চিত্রগ্রাহক ও সম্পাদকের পরিচয়ও তুলে ধরা হয়। এরপর সাময়িকীর নাম 'নিউজপেপার' রেখে দাম নির্ধারণ হয় ৫০ সেন্ট।
ঝুঁকিপূর্ণ এই সাময়িকী প্রকাশের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন টেক্সাসের ২২ বছর বয়সী ডিজাইনার স্টিভেন লরেন্স। প্রকাশনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন পিটার হুজার ও অ্যান্ড্রু উলরিক।
নিঃসন্দেহে 'নিউজপেপার' ছিল ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত 'ভিলেজ ভয়েস'-এর চেয়ে আরও বেশি মৌলিক, পরীক্ষামূলক এবং স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ প্রকাশনা। এ সাময়িকীতে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ে অনেক ছবি প্রকাশিত হতো। সেখানের কিছু ছবি অনেকের অশালীনও মনে হতে পারে।
সময়ের পরিক্রমায় সম্ভবত নিউ ইয়র্কে শিল্পী সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে পড়া এইডসের কারণে বা প্রকাশনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় 'নিউজপেপার' যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। পিটার হুজারের সংগ্রহশালাতেও কোনো কপি পাওয়া যায়নি।
কিন্তু ২০১৫ সালে লেখক, সংগীতশিল্পী ও প্রকাশক ড্যানি ফিল্ডের সংগ্রহশালার আলমারিতে 'নিউজপেপার'-এর অনেকগুলো কপি খুঁজে পান শিল্প ইতিহাস নিয়ে কাজ করা আর্কাইভিস্ট মার্কেলো গ্রেব্রিয়েল ইয়ানেজ। সাময়িকীর হলদে প্রায় চুরচুর হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলো এই গবেষককে আকৃষ্ট করে। আরবাস ও আবেডনের কাজগুলো চিনতে পারেন তিনি। বর্তমানে ১৪টি সংখ্যাই একটি একক ভলিউমে প্রকাশ করা হয়েছে।
'নিউজপেপার' প্রকাশের ঠিক আগে আগেই স্টিভেন লরেন্স নিউইয়র্কে স্থায়ী হন। তার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হওয়া মানুষদের একজন হুজার। তারা কিছু সময়ের জন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাময়িকী প্রকাশের সময় তারা একই বাসায় থাকতেন।
ফটোগ্রাফার হুজারের ছবি 'নিউজপেপার'-এর প্রতিটি সংখ্যাতেই ছিল। কবি তুলি কুফারবার্গ ও অন্ধ সুরকার মুনডগ, সাইকেডেলিক থিয়েটার গ্রুপ দ্য ককেটসের সদস্য ও সমকামী কর্মী জিম ফোরাপের ছবি তোলেন হুজার। পালেরমোর ক্যাটাকম্বসে তোলা কিছু নগ্ন ছবিও রয়েছে।
হুজারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিউজপেপার প্রকাশিত হতে থাকে। তার কাজ প্রদর্শনে সবচেয়ে সেরা মাধ্যম হয়ে ওঠে এটি। অনেক ছোট ছোট ফটোগ্রাফারের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটে। কারণ তখন আর্ট গ্যালারিগুলোতে খুব কমই ক্যামেরায় তোলা ছবি প্রদর্শিত হত। আর এ সুযোগটাই দিত 'নিউজপেপার'।
সাময়িকীর ছবি বাছাই ও সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করার ধরন এর উদ্ভাবনী চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করে। অত্যন্ত সুকৌশলে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ছবিগুলো প্রকাশ করা হতো।
ইয়ানেজ বলেন, ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, গণমাধ্যমের সম্প্রসারণ ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটের মধ্যে 'নিউজপেপার'-এ প্রকাশিত হয়ে মানুষের ছবি, সংবাদ পাঠ ও বোঝার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। হুজারের পরবর্তী কাজেও এরকম ছাপ ছিল।
নিউইয়র্কার ডটকমে লেখক ও সমালোচক ভিন্স আলেত্তি লেখেন, 'নিউজপেপারের উদ্বেগ সে সময়ের জন্য সঠিক ছিল। সাময়িকীটি প্রকাশিত হওয়ার সময়ে ভিন্স কাজ করতেন র্যাট নামের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশনায়। তিনি বলেন, চিত্রায়নের প্রভাবের ক্ষেত্রে নিউজপেপার ছিল অদ্বিতীয়। যদিও ট্যাবলয়েডটি মাঝে মাঝে রাজনৈতিকভাবে উগ্র মনে হতে পারে। পাশাপাশি এর ফটোগ্রাফারদের যৌন প্রবণতাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
১৯৭০ সালে 'নিউজপেপার'কে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অভ মডার্ন আর্টে আয়োজিত একটি বিখ্যাত প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে আরও প্রদর্শিত হয় সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গের শিল্প। এভাবেই প্রাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা এক উদ্যোগ শিল্পে পরিণত হয়ে উঠেছিল।