চট্টগ্রামে ভবন নির্মাণে উচ্চতা নির্ধারিত হবে সড়কের প্রশস্ততার ভিত্তিতে
সড়কের প্রশস্ততা অনুসারে এবার ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, আশেপাশের সড়ক অবকাঠামোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভবন নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ ও মানসম্মত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় অনুমোদিত নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, শূন্য থেকে ২.৫ মিটারের কম প্রশস্ত সড়কের পাশে সর্বোচ্চ ৩ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, ২.৫ মিটার থেকে ৩.৬৫ মিটারের কম প্রশস্ত সড়কের পাশে ৫-৭ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন পাবে। এরপর ৩.৬৫ মিটার প্রশস্ত সড়কের পাশে বিধিমালা অনুসারে অনুমোদন পাবে।
বিধিমালাটি বর্তমানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায় আছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ৬ মিটারের কম প্রশস্ত সড়কের পাশে ভবন নির্মাণ করা যাবে না। নির্মাণ করতে হলে ভূমি মালিককে ৬ মিটার প্রস্তাবিত রাস্তার জন্য প্রয়োজনীয় জমির অর্ধেক ছেড়ে দিয়ে ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিতে হবে।
অর্থাৎ, বিদ্যমান ৩.৬৫ মিটার সড়কের পাশে ভবন তুলতে হলে দুইপাশের ভূমি মালিককে মোট ২.৩৫ মিটার (দুই সম পরিমাণ) ছেড়ে দিতে হবে।
নির্ধারিত সড়কের জন্য ছেড়ে দেওয়া জমি (স্যারেন্ডার ল্যান্ড) থেকে স্থায়ী সীমানা দিতে হবে। এই জমি সিডিএকে রেজিস্ট্রি দিতে হবে। কতটুকু জমি ছেড়ে দেওয়া, কতটুকুতে ভবন নির্মাণ হবে— তাসহ বিস্তারিত তথ্য নির্মাণাধীন ভবনের সামনে সাইনবোর্ড আকারে যুক্ত করতে হবে।
বিষয়টি তদারকিতে যুক্ত করা হবে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদেরও।
নকশা অনুমোদনের সময় ভূমি মালিক প্রস্তাবিত রাস্তার জন্য জমি ছেড়ে (স্যারেন্ডার ল্যান্ড) দেন। পরে ছেড়ে দেওয়া জমিতেও ভবন নির্মাণ হয়। তদারকি সংস্থা সিডিএকে 'ম্যানেজ' করে সরু অলিগলিতেও বড় বড় দালান নির্মাণ করা হয়েছে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) কাজী হাসান বিন শামস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নগরীর সড়কের প্রশস্ততা বাস্তাবায়নের জন্য ৬ মিটার রাস্তার বাধ্যবাধকতা করা হয়েছিল। আদতে তা বাস্তবায়ন হয়নি। মানুষ বেড়েছে। যানবাহন বেড়েছে। কিন্তু সড়ক বাড়েনি। তাই সড়কের প্রশস্ততা অনুসারে নতুন করে উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে।"
তবে সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা হলে নতুন বিধি করেও লাভ হবে না। এখানেও ঘুষ ও দুর্নীতি চলে আসতে পারে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, "বিধিমালার নূন্যতম সুবিধা এই নগরীতে পরিলক্ষিত হয়নি। এটি এক শ্রেণির ঘুষ বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।"
"সিডিএ সবসময় জনবল সংকটের অজুহাত সামনে আনে। কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় না," যোগ করেন তিনি।
সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীন উল ইসলাম বলেন, "নিয়ম না মেনে নির্মিত কয়েকটি ভবন ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। একটিও ভাঙতে পারিনি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাধা ও প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল। এজন্য অনুমোদন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে কঠোর হতে হবে।"
৬ মিটারের নিয়মে প্রশস্ত করা যায়নি রাস্তা
দেশের ইমরাত নির্মাণের ক্ষেত্রে মূলত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করা হয়। এই কোড অনুসারে ভবন নির্মাণের জন্য নূন্যতম ৮ ফুট (২.৪৪ মিটার) রাস্তা থাকতে হবে। বিভিন্ন নগরীর উপযোগিতা অনুসারে বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম মহানগরের ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা করা হয়। এই বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাস্তার প্রশস্ততা কমপক্ষে ১২ ফুট (৩.৬৬ মিটার) করা হয়। ২০০৮ সালের বিধিমালা অনুসারে তা ৬ মিটার করা হয়। কারণ বন্দরনগরী হিসেবে শিল্প-বাণিজ্যিক অগ্রগতির ফলে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে।
এছাড়া, ভূমি পরিমাণ অনুসারে ফ্লোর এরিয়া অনুপাত (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, জমির পরিমাণের গুণ হিসেবে ভবনের মোট ফ্লোর এরিয়া কত বর্গমিটার হবে— তা নির্ধারিত হয়।
২ থেকে ৩ কাঠা জমির ক্ষেত্রে ফ্লোর এরিয়া অনুপাত হয় ২। অর্থাৎ, জমির পরিমাণের দ্বিগুণ ফ্লোর এরিয়ার অনুমোদন রয়েছে। এভাবে উচ্চতা নির্ধারণ করা হয় সাধারণত।
সিডিএর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সেই ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল কোনো বিধিমালা মানায় হয়নি ইমরাত নির্মাণের ক্ষেত্রে।
প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) কাজী হাসান বিন শামস বলেন, "বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের পর থেকে নগরীর এক মিটার রাস্তাও প্রশস্ত হয়নি। উল্টো আরও সংকুচিত হয়েছে।"
কমছে উন্মুক্ত স্থান
শুধু রাস্তার জন্য প্রয়োজনীয় জমির ছেড়ে দেওয়া নয়, ভবন নির্মাণে জমির কতটুকু ব্যবহার করতে হবে— তাও মানা হয়নি।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে, জমির ৬০-৬৭ শতাংশ পর্যন্ত নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যায়। বড় জমির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশও অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া জমির চারপাশে শূন্য ০.৮০ মিটার থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত ফাঁকা রাখতে হয় ভবন নির্মাণের সময়। নগরীর বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের সময় এসব নিয়ম মানা হয়নি।
২০২০ সালে জার্নাল অফ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স প্রকাশিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদিল মোহাম্মদ খানের গবেষণা প্রবন্ধ 'রিভিসিটিং প্ল্যানিং স্ট্যান্ডার্ডস ফর ওপেন স্পেসেস ইন আরবান এরিয়াস ফ্রম গ্লোবাল অ্যান্ড ন্যশনাল পার্সপেক্টিভস'-এ দেশের উন্মুক্ত স্থানের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
প্রবন্ধটির তথ্যমতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ মান হলো শহরে মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার উন্মুক্ত স্থান থাকতে হবে। অথচ বাংলাদেশে মাথাপিছু উন্মুক্ত স্থান মাত্র ০.৬৫ বর্গমিটার। ঢাকায় বর্তমানে ১২৬৬ একর উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। মাথাপিছু হার ০.৭৭ বর্গমিটার। তবে এরমধ্যে জনসাধারণের উন্মুক্ত মাত্র ৪৮০ একর। যার মাথাপিছু হার ০.২৮ বর্গমিটার হয়। চট্টগ্রাম শহরের ২০০ একর উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। এ হিসেবে মাথাপিছু হার ০.২৮ বর্গমিটার।
সিডিএর সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীন উল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বিধিমালা না মানায় উন্মুক্ত স্থান কমছে। এশিয়ার সবচেয়ে কম উন্মুক্ত স্থান বাংলাদেশে। পাশের দেশ ভারতের কলকাতা শহরে মাথাপিছু উন্মুক্ত স্থানের হার ০.৬৭ বর্গমিটার, আর মুম্বাই শহরের হার ১ দশমিক ১ বর্গমিটার। উন্মুক্ত স্থান কমার ফলে সবুজ কমছে। দিন দিন বাড়ছে তাপমাত্রা।"
"এছাড়া ইউটিলিটির ওপর চাপ বাড়ছে। ভবনগুলো মধ্যে প্রয়োজনীয় ফাঁকা জায়গা না থাকায় বর্জ্য অপসারণ তথা ব্যবস্থাপনায়ও প্রভাব পড়ে। অস্বাস্থ্যকর নগরীতে পরিণত হচ্ছে দিন দিন," যোগ করেন তিনি।