বর্তমান তাপপ্রবাহ কি জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে?
দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে এই বসুন্ধরা। চলতি জুলাই মাসের তিন তারিখে বিশ্বের গড় তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড হয়। এর আগে গত বছরও রেকর্ড পরিমাণে বাড়ে গড় তাপমাত্রা। এ বছর বৃদ্ধির পর গত বছরের রেকর্ডের নিচে এখনও নামেনি তাপমাত্রা। দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকা এ উচ্চ গড় তাপমাত্রা কোটি কোটি মানুষের জন্য অশেষ দুর্ভোগের কারণ হলেও – এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি উত্তর-গোলার্ধে অবস্থিত। আর জলভাগের চেয়ে ভূমিই দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একারণে পৃথিবীর জন্য উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মকালই সার্বিকভাবে বছরের সবচেয়ে গরমের সময়। তবে উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকালে সাধারণত আরেকটু দেরিতে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ হতো। কিন্তু, এবছর এতোটা আগে থেকেই তাপমাত্রার আধিক্য শুরু হওয়া, তাও এতটা উচ্চ হারে এবং দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকা – সত্যিই নজিরবিহীন।
এবার দেখে আসা যাক সাগর বা জলভাগে তাপমাত্রা পরিস্থিতি। গত ১৩ মার্চ থেকে পৃথিবীর নিম্ন ও মধ্য অক্ষাংশগুলোতে সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৯৮১ সালের পর সর্বোচ্চ রয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ জলরাশি দক্ষিণ গোলার্ধে; গ্রীষ্মকালে যেখানে সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সবচেয়ে উষ্ণ থাকে। কিন্তু এবছর দক্ষিণ গোলার্ধের শীতেও রেকর্ড মাত্রায় তাপমাত্রা বেশি ছিল সমুদ্রে।
গড় তাপমাত্রা বৈশ্বিক পরিসরে বাড়লেও – স্থানভেদে তা আরও উচ্চ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ডেথ ভ্যালি এমনই চরম তাপমাত্রার জন্য বিখ্যাত। গত জুলাইয়ে ডেথ ভ্যালিতে ৫৩.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপাঙ্কের রেকর্ড হয়। একইদিনে, চীনের ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা-খ্যাত জিনজিয়াং প্রদেশের টার্পান ডিপ্রেশন অঞ্চলে যা পৌঁছায় ৫২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে।
সীমিত বসতির এসব মরু অঞ্চলে তাপমাত্রার উল্লম্ফন নিয়ে অবশ্য আশঙ্কা ততোটা নেই। কিন্তু, যেসব অঞ্চলে শত শত কোটি মানুষের বসবাস – সেখানেও বিপজ্জনকভাবে উচ্চতার রেকর্ড করছে তাপমাত্রা। ভয়টা সেখানেই।
যেমন চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে গত ৬ তারিখে জুলাই মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপের পর কর্তৃপক্ষ রেড এলার্ট জারি করে। দুই সপ্তাহের মধ্যে এটি ছিল নগর কর্তৃপক্ষের দেওয়া দ্বিতীয় তাপ সতর্কতা।
আর জুলাইয়ের ১৯ তারিখ পর্যন্ত টানা ১৯ দিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের ফোনিক্সে ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি ছিল তাপমাত্রা। ইতালি-সহ ভুমধ্যসাগরীয় অনেক দেশেই গরমের এমন প্রচণ্ড প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
গ্রিনহাউজে পৃথিবীবাসী!
'পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাড়তে থাকা গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোই এজন্য দায়ী' বলে স্মরণ করিয়ে দেন একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী। গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির অর্থ – সাগর যতোটা তাপ শোষণ করতে পারে, তার চেয়েও বেশি উষ্ণতা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি আটকে থাকে, কারণ এসব গ্যাস সুর্য-কিরণের উষ্ণতা অনেক বেশি মাত্রায় শোষণ করে।
গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড। আগ্নেয়গিরি থেকেও এর বিপুল নিঃসরণ হয়। গত মে মাসে হাওয়াই দ্বীপের মাউনা লুয়া আগ্নেয়গিরির শিখরে ৪২৪ পার্টস পার মিলিয়ন নিঃসরণ শনাক্ত হয়েছে – যা ৩০ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
এছাড়া, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো দীর্ঘায়ুর গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ এতোটা উচ্চ মাত্রায় হচ্ছে– যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে হয়তো এর আগে কখনোই ঘটেনি। মানুষের কর্মকাণ্ডও দিনে দিনে পৃথিবীকে এক আরও ভয়ানক গ্রিনহাউজে রূপ দিচ্ছে। তবে মানুষ জলবায়ুতে এই পরিবর্তন ঘটানোর আগেই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়েছিল।
স্প্যানিশ শব্দ 'এল নিনো'র অর্থ হলো 'লিটল বয়' বা 'ছোট ছেলে'। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকে, তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। জলবায়ুর প্রাকৃতিক পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো – এল নিনো সাউদার্ন অসোলেশন (বা এনসো)। এর তারতম্যও উষ্ণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্রান্তীয় অঞ্চলের বায়ু ও সমুদ্রস্রোতকে আগেপিছে টেনে উত্তাল করছে এনসো। এতে জলরাশি কখনো তাপ শোষণ করে, কখনোবা বেশি তাপ নির্গমণ করে।
গত জুন মাসে 'এল নিনো' জলবায়ু পরিস্থিতির একটা পর্যায় শুরু হয়– যেখানে তাপ বেশি নির্গত হচ্ছে সমুদ্র থেকে। এল নিনো এখন বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কতোটা গুরুতর প্রভাব ফেলবে সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু, সাগরপৃষ্ঠের বর্তমান তাপমাত্রার গতিশীলতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটি জোরালোভাবেই শুরু হয়েছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন জানান, যে ধরনের উত্তপ্ত গ্রীষ্মকাল আগে প্রতি ১০০ বচর অন্তর আসতো – ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ এর দশকের মধ্যেই তা গড়ে প্রতি পাঁচ বচর অন্তর দেখা দিতে শুরু করে। শ্বাসরুদ্ধকর এমন গ্রীষ্ম বিশ্বের সর্বত্রই দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সার্বিকভাবে তাহলে কি বলা যায় যে, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধি, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে তাপ নির্গমন এবং বছরভেদে তাপমাত্রার তারতম্যই এ বছরের গ্রীষ্মে প্রাণান্তকর উষ্ণতার জন্য দায়ী? নাকি অন্যকিছুও এর পেছনে রয়েছে?
ড. হ্যানসেন অবশ্য তাই মনে করেন। তার মতে, ২০১০ সালের পর থেকেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তীব্রভাবে বদলেছে। উত্তর আটলান্টিকের মতো ঠান্ডা জলরাশির সমুদ্রে উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড যেন এ বছরের গ্রীষ্মকালের এক বিস্ময়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু মডেলার মাইলস অ্যালেন বলেন, "আগামী বছরগুলোয় আটলান্টিকের অস্বাভাবিকতা নিয়ে অনেক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হবে বলে আশা করছি।"
এরকম আরও কিছু ঘটনার পারস্পরিক যোগ উষ্ণায়নকে দ্রুতগামী করছে। এরমধ্যে একটি হলো – ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জে হুঙ্গা টোঙ্গা-হুঙ্গা হাপ্পি' নামক আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। ১৯৯১ সালে ফিলিপাইনের মাউন্ট পিনাটুবু আগ্নেয়গিরির পর যা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী উদগীরণের ঘটনা। পিনাটুবু লাখ লাখ টন সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করেছিল, এতে উচ্চ বায়ুমণ্ডলে সুর্যালোকের প্রবেশ ব্যাহত হয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কমে যায়। আর এই প্রভাব স্থায়ী হয়েছিল প্রায় এক বছর।
তবে হুঙ্গা টোঙ্গা উদগীরণে খুব বেশি সালফার নিঃসরণ হয়নি স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে। কিন্তু, এটি ৭ থেকে ১৫ কোটি টন জলীয়বাষ্প বায়ুমণ্ডলে পৌঁছে দিয়েছে। বাষ্পও এক ধরনের শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের অপেক্ষাকৃত নিম্ন অংশে থাকলে বাষ্প জমে তুষার বা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। কিন্তু, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মতো উচ্চতায় তা আরও দীর্ঘসময় ধরে থাকতে পারে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ১৩ শতাংশ বাড়িয়েছে হুঙ্গা টোঙ্গা। এতে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়তে পারে। তবে হুঙ্গা টোঙ্গা বিশ্বকে উষ্ণ করতে যদি ভূমিকা রেখেই থাকে, তাহলেও সেটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না, এবং এরমধ্যেই তা কমে আসছে বলে মনে করেন তারা।
আরেকটি প্রভাবক হতে পারে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ। হিমযুগের শেষে বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ গ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। ফলে পৃথিবী আবারো ফিরে পায় উষ্ণতর জলবায়ু। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর ধারণা, বর্তমানেও তেমনই হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি ও কৃষি-বিকাশের হাত ধরে বিংশ শতাব্দী জুড়েই বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। একবিংশ শতকের শুরুতে এই বৃদ্ধির হার রেখাচিত্রে কিছুটা সমতল অবস্থানে এসেছিল, কিন্তু এখন তা আবারো দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
সন্দেহ নেই, মিথেন নিঃসরণ বৃদ্ধির পেছনে পশুপালন, কৃষি ও জীবাশ্ম জ্বালানির বড় ভূমিকা এখনও আছে। কিন্তু, এটাই অতিরিক্ত বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন ভূবিজ্ঞানী ইউয়ান নিসবেট ও তার সহকর্মী গবেষকরা।
বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'গ্লোবাল বায়োকেমিক্যাল সাইকেলস' এর প্রকাশের জন্য অনুমোদিত এই গবেষণা নিবন্ধে তারা মতপ্রকাশ করেন, অতিরিক্ত এই মিথেন খুব সম্ভবত নিঃসৃত হচ্ছে ক্রান্তীয় অঞ্চলে জলাভূমি বৃদ্ধির ফলে। এধরনের জলাভূমিতে নানা উদ্ভিদ জন্মায়, যেগুলো পচে মিথেন নিঃসরণ হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, হিমযুগগুলোর শেষদিকেও এ ধরনের ঘটনা আবহাওয়াকে উষ্ণ করার পেছনে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, যত বেশি মিথেনের পরিমাণ বাড়ে, পৃথিবীর উষ্ণতাও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে এবং জলাভূমির সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর সেখান থেকে আরও বেশি মিথেন নিঃসরণ হয়। এভাবেই চলতে থাকে এই চক্র।
এই ধারণা আপাতত অনুমান-নির্ভর। তাই হয়তো সালফার নিঃসরণই অন্যতম মূল কারণ। কয়লা ও ভারী জ্বালানি তেল পোড়ালে বিপুল পরিমাণ সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। বায়ুমণ্ডলে গিয়ে এই গ্যাস সালফেট কণা হিসেবে ভেসে বেড়ায়। এতে ঘটে ব্যাপক বায়ুদূষণ এবং প্রতিবছর তাতে হাজারো মানুষের মৃত্যুও হয়।
গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি পরিবেশ সংস্থাগুলো সালফার নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা করছে।
তবে এর একটি আশ্চর্যরকম বিপরীত দিকও আছে। বায়ুমণ্ডলে সালফেট কণা সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলনের মাধ্যমে মহাশূন্যে ফেরত পাঠায় – যেমনটা প্রাকৃতিকভাবে আগ্নেয়গিরির উদগীরণের মাধ্যমেও স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ঘটে থাকে। কিন্তু, উচ্চ বায়ুমণ্ডল অতন্ত শুষ্ক, সে তুলনায় নিম্ন বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে মানবসৃষ্ট সালফার কণা। নিম্ন বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্পকে নিয়ে সালফার কণা মেঘেরও সৃষ্টি করে। এই মেঘ আরও সূর্যকিরণকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু, সালফার দূষণ নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে – এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সুবিধাটাও দুর্বল হয়েছে। ফলে বাড়তি সুর্যকিরণের তাপ শোষণ করে আরও উষ্ণ হচ্ছে সমুদ্র। এল নিনোর প্রভাবে বাড়তি সেই তাপ আবার বায়ুমণ্ডলে মুক্তি পাচ্ছে, জনজীবন বিপর্যস্ত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতি, পরিবেশ ও কৃষিতেও ঘটাচ্ছে বিপর্যয়।