একজন ক্লাইমেট ক্রুসেডার: এক তরুণ স্বপ্নদ্রষ্টার যেভাবে শুরু
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলাপ-আলোচনা প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়েছে, হয়ে উঠছে ক্রমেই প্রাসঙ্গিক। প্রায় প্রতিবছরই রেকর্ড গড়ছে তাপমাত্রা অনুভূত হওয়ার হার। মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে, উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে, মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। সাথে দাবানল, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই।
বৈশ্বিক এই পরিবর্তন মোকাবেলা করার জন্য কেবল স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধারণই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতাও। সে লক্ষ্যে সারা বিশ্বেই সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন এনজিও কাজ করে যাচ্ছে এর পেছনে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এসব উদ্যোগের পরেও বহু জায়গায় শূন্যস্থান থেকেই যাচ্ছিল, বিশেষ করে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের মধ্যে।
নব্য তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জলবায়ু ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গড়ে তোলা হয় ইকো-নেটওয়ার্ক। শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর সবুজ ক্যাম্পাসে। এক পর্যায়ে তা আর কেবল বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দক্ষিণ এশিয়া আর এশিয়া মহাদেশের সীমারেখা পেরিয়ে চলে গিয়েছে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত। ইকো-নেটওয়ার্ক এখন তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে মোট ২৩টি দেশে, পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে একেবারেই স্থানীয় থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পর্যায় পর্যন্ত। আর এ উদ্যোগের জন্যই ২০২২ সালে সম্মানজনক প্রিন্সেস ডায়ানা অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন ইকো-নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা শামীম আহমেদ মৃধা।
কীভাবে শুরু করেছিলেন ইকো-নেটওয়ার্ক, একে নিয়ে কতদূরেই বা যেতে চান, সেটিই জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পেছনে থাকা মূল কারিগর।
উদ্যোগের শুরু
শামীম আহমেদ মৃধা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৮ সালে, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বা পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে। শুরুতেই সুযোগ পান ইউএনইপি (ইউএন এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম)-এর উদ্যোগ টুনজা ইকো জেনারেশনের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করার। জলবায়ু অ্যাডভোকেসি আর সচেতনতা বিষয়ে শিশু থেকে তরুণদেরকে নিয়ে কাজ করা এই উদ্যোগের ৬ মাসের প্রোগ্রাম শেষ করার পর শামীম ভাবছিলেন কীভাবে এই কাজকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়।
বেশ কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করার পর তিনি বুঝতে পারেন পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তরুণদেরকে একত্র করার মতো প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে তেমন নেই। এরপরই সে বছর নিজের বিভাগের সহপাঠীদেরকে সাথে নিয়ে এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম খোলার উদ্যোগ নেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে, সম্মিলিতভাবে কাজ করা হবে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে।
শামীম জানান, 'প্রাথমিকভাবে ইকো-নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের একত্র করা এবং তাদের মাধ্যমে স্থানীয় প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদেরকে পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখানো। আমাদের মূল টার্গেট হলো টিনএজাররা, কারণ তারাই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ছোট থেকেই যদি তাদেরকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় 'পরিবেশ'ও একটি চিন্তা করার বিষয়, তাহলে তাদের মাধ্যমেই সামনে একটি বড় পরিবর্তন আসবে।'
ইকো-নেটওয়ার্কের যাত্রা বিইউপি থেকে শুরু হলেও বর্তমানে দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকো-নেটওয়ার্কের সদস্য রয়েছে। মূলত পরিবেশ বিজ্ঞান অথবা এর সাথে সম্পর্কিত কোনো বিভাগে পড়েন এমন কাউকেই ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তবে পরিবেশ নিয়ে আগ্রহী অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও এর সাথে সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে পারেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা এরপর নিজেদের উদ্যোগে সেই অঞ্চলের স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোতে সেমিনারের আয়োজন করেন। সেমিনারগুলোতে সহজ ভাষায় শিশু-কিশোরদের বোঝার উপযোগী উপায়ে পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। জানানো হয় পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে, তুলে ধরা হয় কীভাবে মানুষের সচেতন আচরণই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ভয়াবহ জলবায়ু সংকটকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করতে পারে। কেবল গৎবাঁধা বিষয়ই নয়, বরং স্থানীয় এলাকাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী কী সমস্যা হচ্ছে, আর সেটি মোকাবেলা করার জন্য কী করা যেতে পারে, সেগুলোও তাদের সামনে তুলে ধরা হয়। আর এর সবকিছুই করা হয় 'ক্লাইমেট স্কুল প্রজেক্ট'-এর অধীনে। ইতোমধ্যেই এ প্রজেক্টের মাধ্যমে ৪ থেকে ৫ লক্ষ শিশু-কিশোরের কাছে পরিবেশ-জলবায়ু সম্পর্কিত সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে ইকো-নেটওয়ার্ক।
ক্লাইমেট স্কুল ছাড়াও ইকো-নেটওয়ার্কের আরেকটি প্রকল্প হলো 'মিশন গ্রিন বাংলাদেশ'। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ক্রমক্ষীয়মাণ বাংলাদেশের সবুজ রঙকে তাদের পুরনো রূপে ফিরিয়ে দেওয়া। এ জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ হাজার গাছ রোপণ করার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রমগুলো যখন সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হয়, তখন সেখানে যুক্ত থাকা অন্যান্য দেশের তরুণরাও এ ধরনের কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছিল বলে জানান শামীম।
তিনি বলেন, 'সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত থাকা বিদেশি বন্ধুরা যখন আমার কাছে ইকো-নেটওয়ার্কের বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং আমাদের কাজগুলো নিজেরাও শেয়ার করতে থাকে, তখন ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রমকে বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করি আমরা। এরপরেই আমরা আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন দেশে ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ করার ঘোষণা দেই। সেখান থেকেই একে একে ২৩টি দেশে আমাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে।'
বাংলাদেশের পর নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, ফিলিপিন্স থেকে শুরু করে নাইজেরিয়া, কঙ্গো, মালাউই পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় ইকো-নেটওয়ার্ক। মূলত এশিয়া আর আফ্রিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রম, কারণ এই দুইটি মহাদেশের দেশগুলোই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পড়া নেতিবাচক প্রভাবের মূল শিকার। তবে আগামীতে অন্যান্য অঞ্চলেও ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রম ছড়িয়ে যাবে বলে আশা রাখেন শামীম।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পর কার্যক্রম আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইকো-নেটওয়ার্ক। কেবল পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতাই নয়, বরং নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কীভাবে ভূমিকা রাখা যেতে পারে তা নিয়ে শুরু হয় পরিকল্পনা। প্রতিটি দেশের স্থানীয় পর্যায়ে কী সমস্যা রয়েছে, এবং সেই সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে আলোচনা হতে থাকে। দেখা যায়, অঞ্চল ও সংস্কৃতিভেদে সমস্যার যেমন মিল রয়েছে আবার কিছু বৈপরীত্যও রয়েছে।
যেমন- স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা নিরূপণের জন্য, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ডেটা সংগ্রহের জন্য মাঠে নামে ইকো-নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ। জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে কেবল খাবার পানি সংগ্রহের জন্যই অতিরিক্ত সময় খরচ করতে হয় স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে। ফলে আগে যে সময় তারা স্কুলে কাটাতে পারতো, এখন তাদেরকে সেই সময় কাটাতে হচ্ছে খাবার পানি সংগ্রহের জন্য। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের কারণেই তাদের অন্যতম মৌলিক অধিকারের সুযোগ হারাতে হচ্ছে। একইসাথে কৃষকদের ফসলের ফলন তো বটেই, নারীদের মেন্সট্রুয়াল স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পানির লবণাক্ততার কারণে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ শুরুর পরপরই ইকো-নেটওয়ার্ক নজর কাড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের। ডাক পায় বিভিন্ন পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে মিশরের শারম এল-শেইখে অনুষ্ঠিত হওয়া 'কনফারেন্স অফ পার্টিজ' তথা 'কপ ২৭'-এ ইয়ুথ ক্লাইমেট ডেলিগেট হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ পান শামীম। আগামী ডিসেম্বরে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য কপ ২৮-এও অংশগ্রহণের ডাক পেয়েছেন শামীম এবং ইকো-নেটওয়ার্ক মালাউইর কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর সিমিওনে কালুয়া।
কপ ছাড়াও এ বছরের মার্চ মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হওয়া ইউএন ওয়াটার কনফারেন্স, জুন মাসে বনে অনুষ্ঠিত হওয়া বন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে আসছেন শামীম আহমেদ মৃধা।
শামীম জানান, 'এই কনফারেন্সগুলোতে বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে স্পিকার হিসেবে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার; যেখানে ইউনিসেফ, ইউএনডিপির মতো জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে কী ধরনের পরিবেশ ও জলবায়ুগত সমস্যা রয়েছে তা জানার সুযোগ সবসময় তাদের হয়ে ওঠে না। এ ধরনের কনফারেন্সগুলোতে তাদের সামনে একেবারে মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার সুযোগ পাওয়া যায়। যেহেতু তারা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে অর্থায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে জড়িত থাকেন, তাই বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের জলবায়ু সমস্যাগুলো তাদের কাছে উপস্থাপন করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।'
চ্যালেঞ্জ এবং পরিবর্তন
২০২২ সালে প্রিন্সেস ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পরপরই ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রমের চাকা আরও দ্রুত ঘুরতে থাকে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন এনজিওর সাথে একত্রে কাজ করতে থাকে তারা। তবে ইকো-নেটওয়ার্কের শুরুটা এত মসৃণ ছিল না।
প্রথমেই সবচেয়ে বড় যে বাঁধাটি এসেছে, তা হলো 'কী হবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে?' এমন প্রশ্ন। পরিবেশ যে কাজ করার কোনো ক্ষেত্র হতে পারে এটাই অনেকের কল্পনায় আসেনি। 'এগুলো করে কী লাভ?' সেগুলোও জিজ্ঞাসা করেছেন কেউ কেউ। 'তবে গত পাঁচ বছরে মানুষের মধ্যে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা যে সামান্য হলেও বেড়েছে তা বোঝা যায়। তবে এই সচেতনতা একদিনে তৈরি হয় বিষয়টি এমন নয়। দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত চেষ্টার পরই ব্যবহার-চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব।'
প্রিন্সেস ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পাওয়াও পুরো সংগঠনের কার্যক্রমকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছেন বলে জানান শামীম। কাজের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর সব জায়গাতেই আলাদাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছেন, যা এর আগে দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষেরাও বুঝতে পারছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করেও সমাজে অবদান রাখা সম্ভব। এর গুরুত্বটাও জনসাধারণের চোখে আরেকটু প্রকটভাবে ধরা পড়ছে।
'আগের তুলনায় মানুষজন এখন পরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। আর এ কাজে তরুণদেরকেও এখন নিয়মিতভাবে ডাকা হচ্ছে। তাদেরকে কেন্দ্র করেই আলাদাভাবে ওয়ার্কশপ-সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান তাদের সেমিনারে, গবেষণা প্রকল্পে তরুণ গবেষকদেরকে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন। জলবায়ু-পরিবেশ নিয়ে কয়েক বছর ধরে সরকার, এনজিও আর স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত কাজের ফলাফল এটি।'
সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন। স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম হলেও বিভিন্ন সেমিনার থেকে শুরু করে অন্যান্য কার্যক্রম চালানোর জন্য কিছুটা হলেও অর্থ প্রয়োজন। ইকো-নেটওয়ার্ক শুরু হওয়ার পর থেকে এর সদস্যরাই নিজেদের পকেট থেকে সেগুলোর যোগান দিচ্ছেন। অন্যান্য দেশের চ্যাপ্টারগুলোর সদস্যরাও একইভাবে নিজেদের অর্থ সংগ্রহ করছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এনজিওর প্রকল্পে সম্মিলিতভাবে কাজ করার সময় সেই এনজিও-ই অর্থায়ন করছে। এছাড়া কিছু কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থায়ন করে থাকে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কেবল অ্যাডভোকেসি, অ্যাওয়ারনেস বিল্ডিং বা নলেজ ডিসেমিনেশনই নয়, এগুলোর বাইরেও অন্যান্য প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে চায় ইকো-নেটওয়ার্ক। কীভাবে জলবায়ু ও পরিবেশঘটিত বাস্তব সমস্যা সমাধান করা যায় সেজন্য বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছে তারা। এরমধ্যে একটি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পর্কিত প্রকল্প। প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কীভাবে রূপান্তর করা যায়, সেটিই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। এ বছরের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে পারবেন বলে আশা করছেন শামীম।
এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যারা উন্নত প্রযুক্তিগত সহায়তা করতে পারবেন, এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে ইকো-নেটওয়ার্ক। উদ্দেশ্য বিভিন্ন জলবায়ুগত সমস্যা সমাধানের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রকল্প বাংলাদেশেই বাস্তবায়ন করা। শামীম জানান, 'বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা লবণাক্ত পানির এলাকায় কীভাবে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ করা যায়, সে ব্যাপারে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। এরকম কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাংলাদেশে চালু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে যোগাযোগের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।'
২৩টি দেশের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলেও ইকো-নেটওয়ার্কের কার্যক্রম বাড়ানো হবে কিনা জানতে চাইলে শামীম বলেন, তারা নিজেরা আলাদাভাবে নতুন দেশে চ্যাপ্টার খোলার উদ্যোগ নেন না। কেউ যদি আগ্রহী হয়ে তাদের দেশে ইকো-নেটওয়ার্কের চ্যাপ্টার শুরু করতে চান, তবেই তারা উদ্যোগ নেন। যেহেতু এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী একটি প্রতিষ্ঠান, তাই আলাদাভাবে একটি নতুন দেশে কার্যক্রম শুরু করার আলাদা চাপ থাকে না। তবে আগামীতে ইকো-নেটওয়ার্ককে একটি এনজিওতে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান শামীম।
তরুণদের প্রতি বার্তা
ইকো-নেটওয়ার্ক তৈরির পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বলে জানান শামীম। আর তা হলো বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানো; পরিবেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একদল তরুণ তৈরি করা, যারা আগামীতে বৈশ্বিক পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবে। শামীমের মতে, 'আমাদের দেশে এখনো সবাই পড়াশোনার পরপরই গৎবাঁধা চাকরির দিকে ছুটে যায়। কিন্তু এর বাইরেও বেশ বড় একটা জায়গা রয়েছে, যেখানে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে নিজেদেরকে আরও মেলে ধরার। কিন্তু সমস্যা হলো এ ব্যাপারে আমাদের জানাশোনা কম, ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তরুণদের অংশগ্রহণ করার যে বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, তা আমাদের হাতের নাগালের বাইরেই থেকে যায়।'
ইকো-নেটওয়ার্কসহ নানা বৈশ্বিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার আলোকে শামীম জানান, বাংলাদেশের তরুণদের তুলনায় অন্যান্য দেশের তরুণরা, বিশেষ করে আফ্রিকার তরুণরা আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও বেশি সক্রিয়। উন্নয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে তাদের জানাশোনাও বেশি। এমনকি এ ধরনের বিষয়গুলোতে তাদের নানা ব্যতিক্রমী উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো। শামীম বলেন, 'আফ্রিকার তরুণরা সীমিত রিসোর্স নিয়েই যদি এতদূর এগোতে পারে কেবল তাদের আগ্রহ দিয়েই, তবে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণদের পক্ষেও এগুলো করে দেখানো সম্ভব।' ব্যক্তিগত লক্ষ্য ছাড়াও তরুণদেরকে আরও উদ্যমী হওয়ার জন্য, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান শামীম।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমেও জলবায়ু ও পরিবেশকে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হিসেবে তুলে ধরা হয় না বলে মনে করেন শামীম। তার মতে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয় আরও গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হতো, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে এ বিষয়ক সচেতনতা আরও গতিশীলতা পেত। এছাড়া এ বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকাও আরও বাড়ানো উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, 'জলবায়ু ও পরিবেশ হয়তো মুখরোচক কিছু নয়, খুব বেশি মানুষের সাড়া পাবে না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ একেবারে উপরের সারিতেই রয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জলবায়ু শরণার্থী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করলেও নিয়মিতভাবে পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলো গণমাধ্যমে উঠে আসা জরুরি।'
তবে পরিবেশ নিয়েই কাজ করতে হবে এমন নয়। শামীমের মতে, 'সবাই পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে বলে আমাকেও পরিবেশ নিয়েই কাজ করতে হবে, এমন এক প্রবণতা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। মূলত তারা আরেকজনের অনুকরণ করে কাজ শুরু করে। কিন্তু দেখা যায়, এভাবে কাজ করলে বেশিদিন কাজ করার মোটিভেশন থাকে না।' তাই সবার আগে জরুরি, পরিবেশকে বোঝা, পরিবেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা। পরিবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে, পরিবেশের গুরুত্বকে নিজের মধ্যে ধারণ করেই এ কাজে এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করেন শামীম।
বাংলাদেশের তরুণরা আরও বেশি পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠবে, নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকেই নতুন মাত্রায় আরও জোরেশোরে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ক্লাইমেট ক্রুসেডার শামীম আহমেদ মৃধা।