সীমিত আমদানি উৎস, জটিল হচ্ছে খাদ্যশস্য সংগ্রহ পরিস্থিতি
রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি না করা এবং ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের প্রধান দুটি খাদ্যপণ্যের সংগ্রহ নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হলো। এখনই পণ্য দুটির স্থানীয় বাজারে প্রভাব না পড়লেও বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ও আমদানি কমে যাওয়ার শঙ্কায় সামনে সংকট তৈরি হতে পারে।
অন্যদিকে এল নিনো জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে, যেখানে ইতোমধ্যেই বেড়েছে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে চালের দাম।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, 'শস্য চুক্তি না থাকায় গমের জন্য বড় সংকটে পড়বে বাংলাদেশ কারণ সোর্সিং কান্ট্রির সংখ্যা সংকুচিত হয়ে পড়লো।'
তিনি বলেন, 'বিকল্প উৎস থেকে গমের সংগ্রহ বাড়াতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ায় বিশ্বব্যাপী দামবৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'দেশে চালের উৎপাদন এবং সরকারের মজুদ দুটোই ভালো অবস্থানে আছে। এখন আমাদের চাল আমদানির কোন চিন্তা নেই, তবে যে কোন মুহুর্তে জরুরী প্রয়োজনে যাতে দ্রুত আমদানি করা যায় এটা তারই আগাম প্রস্তুতি। জিটুজি পদ্ধতিতে গম আমদানিতেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না।'
গত ১২ জুন অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি'র সভায় খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৫ লাখ টন চাল ও ৬ লাখ টন গম কেনার অনুমোদন দেয়া হয়, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত আমদানি করা যায়।
এই চাল-গম জিটুজি এবং উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিটুজি ভিত্তিতে চাল আমদানিতে সমস্যা হবে না, কিন্তু উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করতে গেলে সরকারকে বেগ পেতে হবে এবং খরচও বেড়ে যেতে পারে। কারণ ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে চাল আমদানির উৎস হিসেবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারই বাকি থাকে।
যদিও জিটুজি ভিত্তিতে গম আমদানিতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না বলে মত দেন তারা।
গম আমদানি
গত ১৩ মে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করে ভারত আর রাশিয়া চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হওয়ায় গত ১৮ জুলাই কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। বন্ধ হয়ে যায় ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি।
এই খবরে বিশ্ববাজারে ৩ শতাংশের মত গমের দাম বাড়লেও সেটা আবার কমে আসে। বিশ্ববাজারে দাম নিম্নমুখী থাকায় দেশের বাজারেও গম ও আটার দাম কমছে।
দেশে বছরে প্রায় ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ১০ লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে আর বাকিটা আমদানি করতে হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৬২.৩% গম এসেছে ভারত থেকে। এছাড়া ৮.৭% ইউক্রেন, ১৩.৩% কানাডা, ৭.৬% অস্ট্রেলিয়া, ২.১% রাশিয়া এবং ৪.৭% এসেছে আর্জেন্টিনা থেকে। দেশের চাহিদা ৭০ লাখ টনের বেশি হলেও এই সময়ে বেসরকারি খাতে মাত্র ৪০ লাখ টন গম আমদানি হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও ৩.৪ শতাংশ কমে নেমে আসে ৩৮.৭৫ লাখ টনে। এর আগে এটি ৫০-৬০ লাখ টনের মধ্যে থাকতো।
আমদানিকারকরা বলছেন, সর্বশেষ বছরগুলোয় দাম ও মান বিবেচনায় বেসরকারী আমদানিকারকদের পছন্দের শীর্ষে ছিল ভারত ও ইউক্রেনের গম। কিছু আমদানিকারক অবশ্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে গম আমদানি করে, যদিও সেখানে দাম বেশ খানিকটা চড়া।
দেশের শীর্ষ খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, চুক্তি নবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে গম আমদানির সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশে কম দামের সাধারণ আমিষযুক্ত গমের অন্যতম উৎস ইউক্রেন।
তিনি বলেন, 'ইউক্রেনের বিকল্প উৎস ভারত গত বছরের মার্চ থেকে গম রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। আবার রাশিয়া থেকে গম আমদানির ঋণপত্র খুলতে অনেক ব্যাংক আগ্রহী নয়। এজন্য দ্রুত বিকল্প সোর্সিং কান্ট্রিতে যাওয়ার বিকল্প নেই। বিকল্প দেশ হিসেবে এখন ব্রাজিল, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া থেকে আমদানি বাড়ানোর চেষ্টা করছি।'
চাল আমদানি
এদিকে এল নিনো পরিস্থিতির কারণে ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ২০ জুলাই চাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিবেশি দেশটি। রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে বলে আগেই অবশ্য থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চালের দাম বেড়েছে, যা এখনো কমেনি।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বোরো মৌসুমে ২.১৫ কোটি মে. টন চাল উৎপাদন হওয়ার কারণে দেশে আপাতত চালের সংকট নেই বলে বাজার স্থিতিশীল রয়েছে, যদিও সেটা উচ্চমূল্যে। যে কারণে বেসরকারি খাতে আমদানির চাপ নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতে চালের (৫% ভাঙ্গা) রপ্তানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৩৭৫ ডলার এবং থাইল্যান্ডে এটা ছিল টনপ্রতি ৪৮৬ মার্কিন ডলার। জুলাইয়ের ১২ তারিখে এই দাম ঠেকে ভারতে ৪১৪ ডলার এবং থাইল্যান্ডে ৫৩৮ ডলার। একইভাবে বেড়েছে আতপ চালের দামও।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, 'আমাদের এখন আমদানি করতে হচ্ছে না বলে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবটা স্থানীয় বাজারে পড়ছে না।'
দেশে এখন বছরে ৩.৫ কোটি টন চালের চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ১০.৫৫ লাখ টন।