মনিপুরের ঘটনায় বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব কী বিজেপির অনুকূলেই কাজ করবে!
মনিপুর নিয়ে ভারতের পার্লামেন্ট উত্তপ্ত। বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। গত মে মাসে দুই আদিবাসী কুকি সম্প্রদায়ের নারীকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে রাজপথে হাঁটানোর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে দেশটির মনিপুর রাজ্য। সেখানকার চলমান সাম্প্রদায়িক হানাহানির তীব্রতা, এতে আরো বৃদ্ধি পায়। পাহাড়ি কুকিরা প্রধানত খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, আর সমতলের মেইতেই জাতিগোষ্ঠী মূলত বিষ্ণু ধর্মালম্বী।
চলমান এ সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সমতলের শত শত চার্চকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। ব্যাপক সম্পদহানি ঘটেছে। পাহাড়ি কুকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমতলের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মনিপুর, যার আঁচ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও পৌঁছেছে। ভারতের লোকসভায় বিরোধী দলগুলো একযোগে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তথা প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করে। ক্ষমতাসীন বিজেপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি বিবৃতিও দেন। তার বিবৃতিতে, মনিপুরের ঘটনাটিকে অন্যান্য রাজ্যের নারী ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে। কিন্তু, অন্য রাজ্যেগুলোর ধর্ষণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করেন বিরোধীরা। তারা মনে করেন, মনিপুরের ঘটনাটি একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ মনিপুরের বর্তমান সরকার বিজেপির।
বিরোধীদের প্রতিবাদ ও দাবির মুখে লোকসভার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের কার্যক্রমও বন্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে সংসদে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। বিরোধীরা সংসদের নির্ধারিত কার্যক্রম বন্ধ রেখে মনিপুরের ঘটনায় সরকারের বিবৃতির দাবি জানায়। এই দাবির পক্ষ-বিপক্ষের বাগবিতণ্ডায় সংসদ অধিবেশন পণ্ড হওয়ার একদিন পরই – বিরোধীদলগুলো মিলিতভাবে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনছে লোকসভার চলতি অধিবেশনে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মনিপুর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। বার্মার সীমান্ত ঘেঁষা মনিপুর বর্মীবাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে ব্রিটিশদের সহায়তা চায়, ১৮২৪ সনে। তখন থেকেই মনিপুর ব্রিটিশ-ভারতের সাথে এক সহায়ক অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্ত হয়ে একটি ব্রিটিশ অধীনস্থ দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়। মনিপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রধানত কুকি, মার ও জো উপজাতি আদিবাসী জনগোষ্ঠি বসবাস করে। সমতলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হলো মেইতেই। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা আদিকাল থেকে আদিম অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাসী ছিল।
কিন্তু, ব্রিটিশ শাসনকালে মনিপুর আশ্রিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর, সেখানে চার্চের প্রবেশ ঘটে। বিশেষত পাহাড়ে। আদিবাসীরা ধর্মান্তরিত হয়ে খৃস্ট-ধর্ম গ্রহণ করে। সমতলের মেইতেইদের মধ্যে বিষ্ণু ধর্মসহ আরো অন্যান্য ধর্মালম্বীও রয়েছে। এদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসীও আছে। মনিপুরের মূল সংকট – মেইতেইদের সাথে কুকি, জো ও মার জাতিগোষ্ঠীর।
মনিপুর ১৯৪৭ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ১৯৪৭ সাল থেকে এই রাজ্যটি কেন্দ্রশাসিত একটি রাজ্য ছিল। ১৯৭২ সালে এটিকে একটি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। রাজ্যটিতে বিধানসভার আসন সংখ্যা ৬০। এখন বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত। লোকসভার আসন ২টি। নির্বাচন হয় ১টিতে অপরটি সংরক্ষিত উপজাতিদের জন্য।
মনিপুরে নারী বিবস্ত্র করার ঘটনার পর কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী অমিত শাহ তার বিবৃতিতে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে নারী ধর্ষণ ও নিগ্রহের বিষয়টিকে তুলে ধরে, বর্ধমানে সাম্প্রতিক এক নারী ধর্ষণের বিষয়টি সামনে এনে মনিপুরের ঘটনাকে হালকা করার চেষ্টা করেন।
ভারতের লোকসভার ইতিহাসে এবারেরটি নিয়ে ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। সংখ্যার বিচারে এ উপমাহাদেশে এটা সর্বাধিক। এর আগের অনাস্থার প্রস্তাবও এই সরকারের বিরুদ্ধেই, ২০১৯ সালে।
অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন এর আগে তিনবার। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ি, ভিপি সিং ও মোরাজি দেশাই। এরা কেউ দলগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন না। জোটগতভাবে সরকার প্রধান ছিলেন। জোট ভাঙ্গনের কারণেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠা প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করেন।
এবারের অনাস্থা প্রস্তাবে পরিণতি সহজেই অনুমান করা যায়। ক্ষমতাসীনদের হাতে ৩৩২টি আসন। এসব আসনের আইনপ্রণেতারা সরকারের প্রতি অনুগত ও একাট্টা। সরকার হয়ত টিকে যাবে। ক্ষমতাসীনরা আরো উন্নাসিক ও বেপরোয়া হবে। ক্ষমতা হারানোর সম্ভাব্য পথগুলো আরও নিদারূণভাবে বন্ধ করার চেষ্টা চালাবে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনগণের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও জুলুম চালিয়ে কোন সভ্য সরকার টিকে থাকতে পারে না।
ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক অনাস্থা প্রস্তাব প্রমাণ করে ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভক্তি তীব্র। যদিও অনাস্থা প্রস্তাব 'নাকচ' হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের 'জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা' আগের মতই আছে, এবং বিরোধীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বলে প্রচার চালাবে। তবে সংসদে যাই ঘটুক না কেন, সেখানকার জাতিগত দাঙ্গা, জীবনহানি, সম্পদের ক্ষতির দায় ক্ষমতাসীন বিজেপি এড়াতে পারে না। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এরপর কীভাবে এগোয়- সেটি এখন দেখার বিষয়।
বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ ভারত। দেশটির সকলের মধ্যে সামাজিক ঐক্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধানের অভাব তীব্র। চীন তার জাতিগোষ্ঠিগুলোর সংকট থেকে বেরোতে পেরেছিল ১৯৫৫ সালে। সেই সময় চীনের নেতৃত্ব পঞ্চান্নটি সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আইন-কানুন বাস্তবায়ন করেছিল। ফলে চীনের সামাজিক সংকট তেমন দেখা যায়নি। জাতিগত সমস্যা চীনে নেই বললেই চলে।
ভারত কিংবা পৃথিবীর আরো কয়েকটি বহু জাতিগোষ্ঠীর রাষ্ট্র যে সংকটে এখনো ভুগছে, তা থেকে চীন অনেক আগেই বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলাই যায়।