বিশ্লেষণ: দানিয়ুবে হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিকে যেভাবে গলা টিপে ধরছে রাশিয়া
ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী দানিয়ুব, ইউক্রেনের মধ্যে দিয়েও বয়ে গেছে। নৌ-যোগাযোগ, পরিবহনের সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিয়েভের শস্য রপ্তানির জন্য দানিয়ুব তীরে গড়ে তোলা শস্য সংরক্ষণ অবকাঠামোগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চলতি সপ্তাহে এসব অবকাঠামোয় বিমান হামলা করেছে রাশিয়া। কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে সরে আসার পর – এ হামলার মাধ্যমে, ইউক্রেনীয় অর্থনীতির প্রধান এক খাতের গলায় দড়ির ফাঁস আরও আঁটো করছে মস্কো।
গত সপ্তাহে এমনই এক বিমান হামলায় ওদেসা অঞ্চলে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে ইউক্রেনের। এরপর সোমবার দানিয়ুব তীরের অবকাঠামোগুলোয় হামলা করা হয়। এসব ঘটনা ২০২২ সালে রুশ আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা- আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
ইউক্রেনের কৃষি পরিষদের উপ-প্রধান ডেনিস মারচুক বলেন, "দানিয়ুব ছাড়া রপ্তানি কঠিন হয়ে পড়বে। স্থলপথে খুব সামান্য পরিমাণ শস্যই (বন্দর পর্যন্ত) বহন করা যায়। মনে হচ্ছে, আমরা রাশিয়ার হামলার শুরুর পর (রপ্তানিতে) যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল, সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি।"
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে ফোনকলে দেওয়া বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, "এছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। কৃষ্ণসাগরের নৌপথ বন্ধ থাকলে, যেসব রুট বাণিজ্যের প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, তার অন্যতম একটি হলো দানিয়ুব নদী।"
ইউক্রেনীয় পুলিশের বরাতে রয়টার্স জানায়, সোমবার দানিয়ুব তীরের শস্যগুদাম ও অন্যান্য পণ্য ধারক ট্যাংকে ড্রোন হামলা চালায় রাশিয়া। ছোট শহর রেনিতে হামলার দৃশ্য একটি ভিডিওতে উঠে এসেছে, এতে শস্য গুদামগুলো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে। ভিডিওটি পরীক্ষার পরে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে রয়টার্স। প্রসঙ্গত, রেনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটের সদস্য রোমানিয়ার কাছে অবস্থিত নৌ-যোগাযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
নিরাপত্তা-জনিত কারণে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বিস্তারিত জানাননি বার্তা-সংস্থাটিকে।
নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান- র্যাবোব্যাংকের কৃষিপণ্য বাজার গবেষণা শাখার প্রধান কার্লোস মেরা বলেন, "নিকট ভবিষ্যতে রাশিয়া এসব বন্দরে হামলা অব্যাহত রেখে, রপ্তানির পথ বন্ধ করবে কিনা– সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।"
সোমবারের হামলার পর থেকেই দানিয়ুব চ্যানেলে নৌ-চলাচল ব্যাহত হয়েছে। বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় চ্যানেলে জাহাজের দীর্ঘ সাড়ি তৈরি হয়েছে। জাহাজের গতিবিধির তথ্য বিশ্লেষক কোম্পানি মেরিন-ট্যাফিকের তথ্যসূত্রে যা জানা গেছে।
রয়টার্সের হিসাবমতে, গুরুত্বপূর্ণ ইজমাইল বন্দরের কাছে ২৩টি জাহাজ ভেড়ার অপেক্ষা করছে। জাহাজজটের কারণে মাত্র তিনটি জাহাজ সোমবার ইজমাইল বন্দর ছেড়ে যায়, আরও তিনটি জাহাজ বন্দরে ভিড়তে সক্ষম হয়।
ইজমাইল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রেনি বন্দরেও সাতটি নৌযানের এক জট তৈরি হয়। এগুলোর বেশিরভাগই অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী জ্বালানিবাহী ট্যাংকার জাহাজ।
বাড়ছে বিমার দর
অকার্যকর হয়ে যাওয়া কৃষ্ণসাগর চুক্তির অধীনে রাশিয়া যেসব বন্দরে হামলা না করার গ্যারান্টি আগে দিয়েছিল, বিমা কোম্পানিগুলোও সেসব বন্দরে চলাচলকারী জাহাজের যুদ্ধকালীন ঝুঁকির বিমা দিত। এখন দানিয়ুবের বন্দরে চলাচলকারী জাহাজকেও একই ধরনের বিমা দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে তারা।
বিমা শিল্পের সূত্রগুলোর বরাতে রয়টার্স জানায়, দানিয়ুবের বন্দরগুলো থেকে চালান বহনের বিমা নিতে মঙ্গলবারে তাদের কাছে আসা আবেদনের সংখ্যা অনেকটাই কমেছে।
বিমা শিল্পের একজন কর্মকর্তা বলেন, "জাহাজের ওপর হামলার চেয়ে অবকাঠামো ধবংসের দিকেই রাশিয়ার লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে, তবে জাহাজে হামলার ঘটনাও ঘটছে।"
আরেকটি সূত্র জানায়, দানিয়ুবের বন্দরগুলোর জন্য বিমা কাভারেজ দেওয়া হলেও, বিমার মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
গত সপ্তাহে রাশিয়ার সাথে কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর থেকেই দানিয়ুব করিডরের গুরুত্ব বেড়েছে কিয়েভের কাছে। সাম্প্রতিক হামলায় ক্ষয়ক্ষতি নাহলে, প্রতি মাসে এই করিডর দিয়ে ২৫ লাখ টন শস্য ও তৈলবীজ রপ্তানি যেত।
সে তুলনায়, সড়ক ও রেলপথে প্রতি মাসে মাত্র ২০ লাখ টন কৃষিপণ্য রপ্তানি করা সম্ভব বলে জানান ইউক্রেনের কৃষি পরিষদের উপ-প্রধান ডেনিস মারচুক।
ইউক্রেনের বিপুল রপ্তানি সম্ভাবনার তুলনায় এটা খুবই সামান্য। চলতি বছর ইউক্রেনে ৪ কোটি ৪০ লাখ টন শস্য উৎপন্ন হবে। যুদ্ধের আগে ২০২১ সালে রেকর্ড ৮ কোটি ৬০ লাখ টন শস্যের ফলন হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম থাকায়, সাধারণত ইউক্রেন তার সিংহভাগ কৃষিপণ্যই রপ্তানি করে।
স্থলপথে তুলনামূলক রপ্তানি করার ক্ষেত্রেও অসুবিধা রয়েছে। ইউক্রেন এই রপ্তানি করে তার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে। কিন্তু, পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের স্থানীয় কৃষকদের চাপের মুখে ইউক্রেন থেকে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ইউক্রেনের শস্য তাদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বাধা হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গত সপ্তাহে ওদেসা বন্দরে শস্য বাণিজ্য-সহায়ক অবকাঠামোয় হামলার পরেই এ সপ্তাহে দানিয়ুব তীরের অবকাঠামোগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানান, চীনে রপ্তানির জন্য ওদেসা বন্দরে রাখা ৬০ হাজার টন শস্য ধবংস হয়েছে। বন্দরে আন্তর্জাতিক খাদ্য বাণিজ্যে জড়িত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান- কার্নেল, ভিটেরা এবং সিএমএ সিজিএম গ্রুপের মালিকানাধীন অবকাঠামো ধবংস হয়েছে।
কার্নেল গ্রুপ জানিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি মেরামতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। ক্ষতির পরিমাণ 'উল্লেখযোগ্য' বলে উল্লেখ করেছে ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ।
মারচুক জানান, ধবংস হওয়া শস্যের বাজারমূল্য ছিল কমপক্ষে ৮০ লাখ ডলার, শস্যবাহী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এলিভেটর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। "এসব এলিভেটরের দামও কোটি কোটি ডলার"- যোগ করেন তিনি।