প্রকৃতির প্রতি সদয় হয়ে শহরগুলো যেভাবে গড়ে তোলা যায়
বিশ্বের জনসংখ্যার বেশিরভাগ এখন শহরাঞ্চলে বাস করে। মানুষের কার্যকলাপ কীভাবে দুর্গম এবং বন্য অঞ্চলগুলোকে প্রভাবিত করে তা বোঝা চ্যালেঞ্জের। সিএনএন-এর উদ্যোগে আয়োজিত 'কল টু আর্থ ডে'- তে এবার শহরাঞ্চলের সাথে জনমানবহীন স্থানের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ নিয়ে আলোকপাত করা হবে। এছাড়া দূরবর্তী প্রাকৃতিক স্থানগুলোতে শহরগুলোর প্রভাবের উপরও নজর দেওয়া হবে।
চলতি বছরের কল টু আর্থ ডে অনুষ্ঠিত হবে ৮ নভেম্বর। এবারের থিম বা স্লোগান হল 'আওর শেয়ারড হোম'। এখানে হোম অর্থাৎ পৃথিবী, যা মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। শহর, শহরতলি, সমভূমি, পাহাড়, জঙ্গল এবং অন্য জায়গাতেও আমাদেরকে অবশ্যই বাস্তুতন্ত্র রক্ষা ও লালন করতে হবে।
এই প্রতিবেদনে শহরগুলোতে কীভাবে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান হতে পারে এবং কীভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় শহরগুলো অবদান রাখতে পারে তা তুলে ধরা হয়েছে।
দূষণ মুক্ত রাখা
শহরগুলোতে দূষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপী ৭৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ হয় শহরগুলো থেকে। এছাড়া সমুদ্রে পতিত হওয়া মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ আসে শহর থেকে। তবে বিশ্বজুড়ে দূষণ প্রতিরোধে অভিনব কৌশল বাস্তবায়নের নজিরও আছে।
যেমন ভারতের পবিত্র নদী খ্যাত গঙ্গার তীরবর্তী শহর বেনারস এর বড় উদাহরণ। সেখানের মন্দিরে অর্পিত ফুলগুলো সব নদীতে গিয়ে পৌঁছাত। পরে স্থানীয় উদ্যোগে ফুলের বর্জ্য সংগ্রহ করে টেকসই পণ্যে রূপান্তর করা শুরু হয়।
এসব বর্জ্য থেকে ভিন্ন পণ্য উৎপাদন করার মাধ্যমে নদীর দূষণ এবং বর্জ্য যেমন হ্রাস হয় তেমনি স্থানীয়দের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। ফুলের বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সাধারণত কার্বন-মুক্ত ধূপ এবং পরিবেশ বান্ধব কৃত্রিম চামড়া তৈরি করা হয়।
এই প্রয়াস তুলে ধরে যে, কীভাবে সাংস্কৃতিক চর্চা এবং পরিবেশ সচেতনতা একসাথে চলতে পারে।
বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি
নগরায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে, একই সাথে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিও হচ্ছে। নগর উন্নয়নের ফলে ২১০০ সালের মধ্যে ১১ থেকে ৩৩ মিলিয়ন হেক্টর প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারিয়ে যাবে। তবে, বিশ্বজুড়ে অনেক শহর প্রাণীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করতে কাজ করছে।
হংকং-এর মতো শহর এখন হলুদ রঙের ককাটু পাখির আবাসস্থল। অথচ প্রাণীগুলো এখানকার স্থানীয় নয়। শুধুমাত্র বিপন্ন প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণ করার প্রয়াসে নিরাপদ বাসা বাঁধার জায়গা তৈরির কারণে এখন হংকং ককাটুগুলোর আবাস্থলে পরিণত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ককাটুর ১০ শতাংশের আবাস এখন হংকং-এ। এ বিষয়টি দেখায় যে, শহরও বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ স্থান হতে পাারে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শহরে বন্যপ্রাণীর জন্য শহুরে বাসস্থান প্রদানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেমন- শহরের জলপথে ভাসমান বাস্তুতন্ত্রের প্রবর্তন করা হচ্ছে। এতে শহুরে জলজ প্রজাতি আশ্রয় পাচ্ছে।
শহরায়নের সাথে সাথে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সবুজ স্থানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রাণীদের বিচরণের সুযোগ দেওয়া
শহরের বিস্তৃতির ফলে প্রাণীরা তাদের একসময়ের উন্মুক্ত স্থানগুলোতেই বিচরণ করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হচ্ছে। বিচরণের সড়কপথ এমনকি পাখিদের উড়ার পথও হুমকির মুখে।
বন্যপ্রাণীর অভিবাসন পদ্ধতির ব্যাঘাতের উপর ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গবেষণায় অন্তুর্ভুক্ত প্রাণীদের এক তৃতীয়াংশ মানুষের কার্যকলাপ যেমন শিকার, কৃষি এবং গাছ কাটার কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণে তাদের স্বাভাবিক রুট পরিবর্তন করেছে।
বন্যপ্রাণীর জন্য নির্মিত সেতু, টানেল এবং করিডোর প্রাণীদের নিরাপদে বিচরণের সুযোগ দিচ্ছে। যেমন কানাডার ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কে এ ধরনের সেতু তৈরি করা হয়েছে।
এই উদ্যোগগুলো মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে সহাবস্থানকে উৎসাহিত করে, যাতে প্রাণীরা ব্যস্ত রাস্তায় তাদের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে অবাধে বিচরণ করতে পারে।
প্রকৃতি বান্ধব ভবন
জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে শহরের বিস্তৃতি হবে এব্ং সেগুলো প্রাকৃতিক দৃশ্যকে গ্রাস করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ভবনগুলো সবুজায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সহায়তা করা সম্ভব।
প্রকৃতি-বান্ধব ভবনগুলো পরিবেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্য রাখে। এই ধরনের ভবনে সবুজ ছাদ ও উল্লম্ব বাগান থাকে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী নকশার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমায়।
কার্বন-নিরপেক্ষ অফিস ভবন থেকে শুরু করে গাছপালায় আবৃত পেন্টহাউস পর্যন্ত, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শহর এখন জলবায়ু-বান্ধব নির্মাণ কৌশল গ্রহণ করছে। কিছু শহরে প্রকৃতি-বান্ধব বৈশিষ্ট নকশায় রাখার ক্ষেত্রে প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।
শহর এবং প্রকৃতির মিশ্রণের মাধ্যমে, এই ভবনগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সবুজ শহর তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।
সহাবস্থান
দূষণ কমানোর মাধ্যমে শহরগুলোকে পরিচ্ছন্ন রাখা, বন্যপ্রাণীর জন্য স্থান তৈরি করা, প্রাণীদের চলাচলের সুবিধা দেওয়া এবং প্রকৃতি-বান্ধব ভবন নির্মাণের অর্থ হল মানুষ এবং প্রকৃতিক মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও টেকসই সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো শুধুমাত্র স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যকে উপকৃত করে না বরং শহরবাসীদের স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মানও উন্নত করে।