দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় ৩৫ লাখ শিশুকে স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় আনার উদ্যোগ
বড় পরিসরে দেশে 'স্কুল ফিডিং' কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে সরকার। উদ্দেশ্য হলো- দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় নির্দিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের (ড্রপআউট) পাশপাশি স্কুলে ভর্তি এবং উপস্থিতির সংখ্যা বাড়ানো।
সরকারের স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম-ফেজ-১ নামে নতুন এই প্রকল্পের আওতায় ১৫০টি উপজেলার ১৮,০০০-১৯,০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩৫ লাখ শিশুকে সারাবছর স্কুল চলাকালীন খাবার সরবরাহ করা হবে।
আনুমানিক ৬,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছরই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে চায় সরকার। যদিও এর আগে, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সরকার অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন, অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূরজাহান খাতুন জানান, প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটি জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
নূরজাহান খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের পর, অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য এটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে পাঠানো হবে।"
অতিরিক্ত সচিব আরও জানান, ইতোমধ্যে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) সহ আরো কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
"আশা করছি, দ্রুতই অর্থায়নের সুখবর পাওয়া যাবে," যোগ করেন তিনি।
নূরজাহান খাতুন বলেন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) সহায়তায় মূল প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। এরপরই এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
প্রাথমিক প্রস্তাব অনুযায়ী, এই কর্মসূচির মাধ্যমে দুই ধরনের খাদ্য বিতরণ করা হবে- সর্বাধিক টার্গেটেড এলাকায় সপ্তাহে পাঁচ দিন শিক্ষার্থীদেরকে ফোর্টিফাইড বিস্কুট, বান, ফল (কলা), ডিম এবং দুধ সমন্বিত একটি বৈচিত্র্যময় খাদ্যতালিকা সরবরাহ করা হবে। এছাড়া, কিছু নির্বাচিত উপজেলার শিশুদেরকে সরবরাহ করা হবে রান্না করা পুষ্টিকর খাবার।
রান্না করা খাবারটি সপ্তাহে এক বা দুবার দেওয়া হবে। এই খাবার প্রস্তুত করা হবে ফোর্টিফাইড চাল, লাল মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, শাকসবজি এবং ডিম দিয়ে। বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে রান্না করা খাবারের পরিসর ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে।
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫০৯টি উপজেলার প্রায় ১.৪৮ কোটি শিশুকে খিচুড়ি এবং বিস্কুট সরবরাহ করতে ১৯,২৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি স্কুল ফিডিং প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিল।
২০২১ সালের জুনে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পরামর্শ দিয়ে প্রকল্পটি ফেরত পাঠায়।
সেই অনুসারে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে বেশকিছু বিকল্প যাচাই করে দেখা যায়, ফোর্টিফাইড বিস্কুটই সবচেয়ে সস্তা বিকল্প। প্রতি উপজেলায় ১৩২টি স্কুল এবং প্রতি স্কুলে ২০৮ জন শিক্ষার্থী ধরে একটি উপজেলার জন্য খরচের গড় হিসাব তৈরি করা হয়েছে।
এই ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতি শিশুকে প্রতিদিন বিস্কুট খাওয়ানোর সর্বনিম্ন খরচ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮.৭৪ টাকা এবং রান্না করা খাবারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খরচ দাঁড়িয়েছে ৪০.৪৭ টাকা।
এছাড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন আইটেমের খাবারও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে খরচের হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রান্না করা খাবার অন্তর্ভুক্ত করা না হলে খরচ দাঁড়ায় ৩৩.৩০ থেকে ৩৮.২০ টাকা এবং যদি সপ্তাহে দুইবার রান্না করা খাবার দেওয়া হয়, তাহলে খরচ হবে ৫৩.৯০ টাকা।
কর্মকর্তারা জনান, প্রকল্পটি চালু করতে এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা এবং স্টেকহোল্ডারদের ডব্লিউএফপির প্রযুক্তিগত সহায়তায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এর আগে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, ইউরোপীয় কমিশনের অর্থায়নে দেশের ১০টি উপজেলার ১,২৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩,১৫,০০০ শিশুকে ফোর্টিফাইড বিস্কুট সরবরাহের আরেকটি স্কুল ফিডিং প্রকল্প পরিচালিত হয়েছিল।
ইউরোপীয় কমিশনের তহবিল পর্যায়ক্রমে বন্ধ হওয়ার পর, ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচির সঙ্গে একীভূত করা হয়।
বিস্কুটের পাশাপাশি সরকার ২০১৯ সালের অক্টোবরে ১৬টি উপজেলায় স্কুলের শিশুদের জন্য একদিন পর পর রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা চালু করে। রান্না করা খাবারটি ফোর্টিফাইড চাল, লাল মসুর ডাল, সয়াবিন তেল এবং স্থানীয় ক্ষেত-খামারের তাজা শাকসবজি দিয়ে প্রস্তুত হয়; এছাড়া শিশুদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ও খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনতে সপ্তাহে একবার ডিমও দেওয়া হতো। এই খাবার শিশুদের দৈনিক ৫৩৬-৫৮৭ কিলোক্যালরি সরবরাহ করার পাশাপাশি তাদের পুষ্টি চাহিদার অন্তত ৫০ শতাংশ পূরণ করে।
প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ হয়ে পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১০৪টি উপজেলায় প্রায় ৩০ লাখ স্কুল শিক্ষার্থীকে স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব হয়। এরমধ্যে ৯৪টি প্রকল্পে সরকার এবং ১০টি প্রকল্পে অর্থায়ন করে ডব্লিউএফপি।