তাঁরে স্মরি—কবি মোহাম্মদ রফিক
চলে গেলেন 'খোলা কবিতার' কবি মোহাম্মদ রফিক। এখন লন্ডনে ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো পেরিয়ে গেছে। মনে পড়ল, আশির দশকে বহুদিন তাঁর সঙ্গে কথায়, আড্ডায়, তর্ক-বিতর্কে রাত দুটো কি পার করে দেইনি? সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি থেকে শুরু করে ঠাট্টা, চুটকি, পরচর্চা সবই হয়েছে। আমার বহু মনন, বহু জানা এবং বহু রুচির পরিচয় তো তাঁর কাছেই।
বিশ্বসাহিত্যের নানান বিষয় আমরা একে অন্যকে জানিয়েছি। বইয়ের আদান-প্রদান হয়েছে অনেক সময়েই। সমাজ বিষয়ে মতামত বিনিময় হয়েছে প্রায়শই। আমি তাঁর কবিতার ভক্ত ছিলাম, তিনি আমার গদ্যকে বলতেন, 'ঝরঝরে গদ্য'। শিক্ষকতা করতাম দু'জনেই—যদিও ভিন্ন বিষয়ে এবং আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ইংরেজীর, আমি অর্থনীতির; তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটা সমমনা সহমর্মিতা, হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে।
আমি তাঁকে 'খোলা কবিতার' কবি বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। ওই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কাছাকাছি সময়ে বেরিয়েছিল তাঁর অন্য কবিতার বই 'কপিলা' ও 'কীর্তিনাশা'। ওই সব বইয়ের বহু পঙক্তি আমার কণ্ঠস্থ ছিল এবং সেগুলো আমি আমার বহু লেখায় ব্যবহার করেছি। অন্য যে কবিবন্ধুর কবিতা আমার লেখায় বারবার উঠে এসেছে, তিনি হচ্ছেন কবি হেলাল হাফিজ।
কিন্ত রফিক ভাইয়ের কাছে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া যে তিনি আমাকে আমার লেখার সনাতন বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নতুন বৃত্ত তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সে সময়ে আমি মূলত অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজ নিয়েই লিখতাম। পত্রপত্রিকায়, বিশেষত দৈনিক সংবাদে আমার পাক্ষিক কলাম 'কড়ি-কড়চা'তে তার ছাপ সুস্পষ্ট। রফিক ভাই-ই আমার কলমের মুখ সাহিত্য বৃত্তের দিকে ঘোরালেন।
সেটা সম্ভবত নব্বুইয়ের একেবারে শেষের দিক। জাতীয় কবিতা উৎসব সবে শেষ হয়েছে। মূল প্রবন্ধ পড়েছেন মনজুর ভাই—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিরোনাম 'কবিতার ভবিষ্যত'। উচ্চাঙ্গের লেখা—যুক্তিপূর্ণ, সুচিন্তিত, শক্তবাঁধুনির সুলিখিত প্রবন্ধ। কিন্ত আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল লেখাটা বড় বেশি সাহিত্যকেন্দ্রিক, অবশ্য ইংরেজী সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র মনজুর ভাইয়ের কাছে সেটাই প্রত্যাশিত। কবিতার ভবিষ্যৎ শুধু বিমূর্ত সাহিত্যের গতিধারা-নির্ভর হতে পারে না, একটি সমাজের আর্থসামাজিক বিবর্তনও সে ভবিষ্যত নির্ধারণের একটি নিয়ামক শক্তি বটে।
একদিন রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দে'য়ার সময়ে এ প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, 'লিখে ফ্যালো। লিখে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে দিয়ে দাও।' তিনি তো বলে খালাস, কিন্তু আমি সাহস করি না। এই এলাকা আমার পরিচিত নয়—সাহিত্যের পাঠক এক কথা, আর সাহিত্য বিষয়ে লেখা ভিন্ন কথা। তাছাড়া সংবাদে যে নিয়ে যাব, সেখানে পাশাপাশি বসে আছেন আমাদের হাসনাত ভাই আর সন্তোষ'দা—সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত আর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক সন্তোষ গুপ্ত। হাসনাত ভাই কিছু না বললেও সন্তোষ'দা ছেড়ে দেবেন না। হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলবেন, 'যেডা জানেন না, হেডা লইয়া আমনেরে ল্যাখতে কইছে কেডা?' আমার সঙ্গে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা কইতেন সন্তোষ'দা।
রফিক ভাই লেখাটা লিখতে তাড়া দিতেই থাকেন—'শুরু করেছ কি, কদ্দূর?' 'পারবে, পারবে, একবার শুরু করলেই পারবে। আর তুমি যা বলছ, তারমধ্যে তো যুক্তি আছে,'—উৎসাহ দেন তিনি। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছি। বসি ১৪ নম্বর দালানে কমিশনের প্রাক্তন সদস্য প্রয়াত অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুক সাহেবের বিশাল কক্ষে। শুধুমাত্র রফিক ভা'য়ের তাড়না থেকে বাঁচতে অনেকটা বিকারগ্রস্ত জ্বরো রুগীর মতো এক দুপুরে খাওয়া-দাওয়া ভুলে অনেকটা একটানেই লিখে ফেললাম পুরোটা লাইনটানা লম্বা হলুদ কাগজে 'কবিতার ভবিষ্যত'।
লেখার সমাপনী বাক্যটি শেষ হতেই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। নিজে নিয়ে যেতে যারপরনাই কুণ্ঠা, আমাদের গাড়ির চালক রশীদকে দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম। তারপর উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা। বৃহস্পতিবার সংবাদ বাড়িতে এলে সাহিত্য সাময়িকী খুলে দেখি প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম লেখা 'কবিতার ভবিষ্যত'। মোটা কালো কালিতে লেখা 'কবিতার' নিচে একটু ডানে চারকোল ব্যবহার করে ধূসর করে বড় অক্ষরে লেখা 'ভবিষ্যত'। সেই প্রথম সংবাদ সাহিত্য সাময়িকী শিরোনামে চারকোল ব্যবহার করেছিল।
একটু পরে অভ্রান্তভাবে দুটো তাৎক্ষণিক ফোন এলো—প্রথমটি হাসনাত ভাই। 'দেখেছেন লেখাটা? চারকোলে শিরোনাম অলংকরণ করে দিয়েছি। সাময়িকীতে প্রথম। কিন্তু লেখাটি সত্যিই ভালো হয়েছে।' হাসনাত ভা'য়ের কথাগুলোই মনে আছে, আমি কী বলেছিলাম, মনে নেই। দ্বিতীয় ফোনটি পিতৃপ্রতিম প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কাছ থেকে। 'আজ সকালে একটা লেখা দেখলাম সংবাদে—কবিতার ভবিষ্যত। লেখক কি তুমিই?' একটু দ্বিধান্বিত তাঁর গলা। 'জি, আমারই লেখা,' আমি নম্রস্বরে বলি। 'বলো কী?' তিনি তাঁর গলায় চমক ও চমৎকৃত্বতা কোনোটাই ঢাকতে পারেন না।
রফিক ভাইয়ের প্রেরণা, আস্থায়, আশস্বততায় সেদিন আমার লেখার একটি নতুন বলয় তৈরি হয়েছিল—সে আমি ভুলিনি। ওই লেখার হাত ধরেই তো আমার সনাতন সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি লেখার বৃত্তের বাইরে পরবর্তী সময়ে 'শার্সিতে স্বদেশের মুখ', 'আমার বন্ধু বিমলকান্তি' কিংবা 'আমার বুদ্ধিজীবী বান্ধবদের' মতো লেখা লিখতে পেরেছি। আজ যে বহুধা বিষয়ে লিখি, তারজন্য আমার ইচ্ছা, উৎসাহ এবং আত্মবিশ্বাস তৈরিতে কবি মোহাম্মদ রফিকের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি হয়তো জানেন না, তাঁর হয়তো মনেও নেই—কিন্তু আমি তো জানি, এবং আমার তো মনে আছে।
আশির দশকে রফিক ভাই আর আমার আড্ডা অনেকটা 'মেঘে কাদায়' বিস্তৃত ছিল—বর্ষা, গ্রীষ্ম, শীত পেরিয়ে। প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায়—বেনু তাঁর খুব পছন্দের মানুষ ছিল। আমিও মাঝে মাঝে চলে যেতাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রীনু'পার (অধ্যাপক শাহীন কবীর) কক্ষে আড্ডা জমে উঠত। মাঝে মাঝে আমরা খেতে চলে যেতাম জাতীয় স্মৃতিসৌধের উল্টোদিকে পর্যটনের রেস্তোরায়। বইমেলা বা পহেলা বৈশাখে তো দেখা হতোই। কী যে সব দিন গেছে। আমি বাইরে চলে এলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে।
বছর তিনেক আগে আবার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয় অবয়বপত্রের কল্যাণে। গতবছর রফিক ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর উত্তরার বাড়িতে। কী আদর যে করেছিলেন! রোদেলা দুপুরে বারান্দায় তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে মনেই হয়নি মাঝে কত বছর যে কেটে গেছে। 'সব শালা কবি হবে', তার সেই অবিস্মরনীয় পঙক্তি নিয়ে কী যে হাসি-তামাশা আমাদের দু'জনার।
জানি, নক্ষত্রদেরও চলে যেতে হয়। আজ চলে গেলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। বড় মমতায় স্মরণ করি তাঁকে। জন্মদিন। 'তাঁরে স্মরি' প্রতিদিন, নিত্যদিন, সর্বদা।
- সেলিম জাহান: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগসহ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
- [লেখাটি সেলিম জাহানের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত]