প্রতি ৯০ সেকেন্ডে একটি করে স্কুটার! ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ির নতুন বিপ্লব
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর হোসুর শহরের একটি স্টার্টআপ কারখানায় বিদ্যুতের গতিতে চলছে কাজ। ব্যাঙ্গালোর থেকে খুব বেশি দূরে নয় এই কারখানাটি; এখানে কালো ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা প্রতি ৯০ সেকেন্ডে একটি করে ব্র্যান্ড-নিউ ইলেক্ট্রিক স্কুটার উৎপাদন করছেন, অন্যদিকে নির্বাহী কর্মকর্তারা কোম্পানির আকাশচুম্বী বিক্রয়ের হিসাব পর্যালোচনা করছেন।
ইলেক্ট্রিক স্কুটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এথার এনার্জি'র ৩৩ বছর বয়সী সিইও তরুণ মেহতা বলেন, "দুই-চাকার বাহন এখন তুমুল গতিতে বৈদ্যুতিক গাড়িতে রূপ নিচ্ছে।"
তিন বছর আগেও কোম্পানিটি মাসে ২০০ ইউনিট বিক্রি করতো, কিন্তু এখন প্রতি মাসে হেসেখেলেই ১৫,০০০ ইউনিট বিক্রি হয় বলে জানান তরুণ মেহতা।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, "আমাদের আয় এখন আকাশচুম্বী।"
ভারত তাদের যানবাহনের বাজারে বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়ায় এমনই চিত্র দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ জায়গায়। ২০৩০ সালের মধ্যেই এটিকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি শিল্পে রূপান্তরিত করতে চান তারা। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশটিতে দুই ও তিন-চাকার বাহন অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হয়; যেমন, প্রাইভেট কারের চাইতে এগুলোর ব্যবহার চার গুণ বেশি।
নয়াদিল্লি বা ব্যাঙ্গালোরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেই এর যথেষ্ট প্রমাণ মেলে। ইলেক্ট্রিক মোপেড যা ১০০০ ডলারেরও কম দামে কিনতে পাওয়া যায়, রাস্তায় এই বাহনগুলো প্রচুর দেখা যায়। পরিবেশবাদীরা এবং সরকার ভারতের শহরগুলোকে গ্রাস করে ফেলা বিষাক্ত ধোঁয়ার চাদর খানিকটা কমানোর উপায় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এই বাহনগুলোকে।
গত তিন বছরে ভারতজুড়ে এ ধরনের বাহন রেজিস্ট্রেশনের পরিমাণ ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের রাজধানীতে রংবেরং এর রিকশাগুলো একসময় পায়ে চালাতে হতো, কিন্তু বর্তমানে এসব রিকশাও ব্যাটারিতে চলে।
বাজারে যেসব কোম্পানি এরই মধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে, যেমন- হিরো মোটোকর্প দুই চাকার বাহন নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তারাও তাদের বৈদ্যুতিক বাহনে পরিণত করার দিকে বিনিয়োগ করেছে।
অন্য অনেক দেশের মতো ভারতও সবুজায়নের লক্ষ্যে ছুটছে। এই দশক শেষ হওয়ার আগেই দেশের মোট প্রাইভেট কার বিক্রির এক-তৃতীয়াংশ এবং দুই ও তিন-চাকার বাহন বিক্রির ৮০ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ি হিসেবে বিক্রি করা তাদের লক্ষ্য। এই কাজের মাধ্যমে উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের জন্য মডেল স্থাপন করতে চায় ভারত।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে বেশকিছু বাধা পেরোতে হবে; যার মধ্যে রয়েছে দাম কমিয়ে আনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
দুই-চাকার 'বিপ্লব'
"গত তিন বছরে এই শিল্পের বাজার উল্লেখযোগ্য গতি লাভ করেছে", বলেন ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির একজন অংশীদার ব্রজেশ ছিব্বর। ভবিষ্যতে ভারতে কোম্পানিটি কতটা সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে সে বিষয়ে থিংক ট্যাংক টিমের সহ-নেতৃত্বে আছেন তিনি।
গত বছর বিক্রি হওয়া মোট দুই-চাকার গাড়ির প্রায় ৭ শতাংশ ছিল বৈদ্যুতিক গাড়ি। অথচ তিনবছর আগেও এই সংখ্যা গোনায় ধরার মতো ছিল না, জানান ব্রজেশ। তার ভাষ্যে, 'দুর্দান্তরকম উন্নতি হয়েছে এখানে।'
এদিকে রাষ্ট্রীয় সহায়তা, বিশেষ করে ফাস্টার অ্যাডপশন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অব ইলেক্ট্রিক ভেইকেলস (ফেম) নামক একটি নীতির মাধ্যমে এই শিল্পের বাজার আরও গতি পেয়েছে।
২০১৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রোগ্রামে গ্রাহকদের জন্য ইলেক্ট্রিক ভেইকেল-ইভিতে ভর্তুকি দেওয়া এবং দেশজুড়ে হাজার হাজার ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপনের জন্য ১০০ বিলিয়ন রূপিরও বেশি (১.২ বিলিয়ন ডলার) ব্যয় করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে এই ভর্তুকির বড় ভূমিকা রয়েছে।
এথার এনার্জিস এই পরিবর্তনকে একটা 'বিপ্লব' এর চেয়ে কম কিছু ভাবছে না। যে কয়েক ডজন স্টার্টআপ কোম্পানির এই খাতে লাভ হচ্ছে, এথার তার মধ্যে একটি। সরকারি ডেটা অনুযায়ী, এথারসহ আরও ৫৫টি বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের চাহিদা পূরণে কাজ করছে।
তবে ভারতে এই 'বিপ্লব' মাত্র শুরু হয়েছে। গতবছর ১ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রির মাধ্যমে এক মাইলস্টোন অর্জন করা সত্ত্বেও, ভারতে দুই ও তিন-চাকার বাহনের স্টক ২৫০ মিলিয়নের তুলনায় এটি খুবই সামান্য। অর্থাৎ এখানে টেকসই উন্নতির আরও অনেক সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)।
যেহেতু দেশটিতে গণপরিবহন এখনও অনুন্নত, তাই স্কুটার, মোটরসাইকেল, রিকশার মতো বাহনগুলো জনসাধারণের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং মোট গাড়ি বিক্রির ৮০ শতাংশই হলো এসব বাহন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূরপাল্লার ভ্রমণের চাইতে বরং কম দূরত্বে যাওয়া-আসা করার জন্যই এই বাহনগুলো বেশি জনপ্রিয়, তাই সাম্প্রতিক ইভি'র ট্রেন্ডে এগুলোর চাহিদা আরো বেড়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদনে বেইন সম্ভাব্য অনুমান করেছিল যে দুই ও তিন-চাকার বাহনই হবে 'বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের অগ্রদূত'; এর আংশিক কারণ ব্যবহারকারীদেরও হয়তো চিন্তা হতে পারে, পাবলিক চার্জিং অবকাঠামোর পরিবর্তে তারা হয়তো 'হোম চার্জিং এর সুবিধা'কেই বেশি পছন্দ করবে।
আরও একটি চালিকাশক্তি হলো, ডেলিভারি ও লজিস্টিকস কোম্পানিগুলো খুব দ্রুত ইভি ব্যবহারে দিকে ঝুঁকেছে, এতে খরচ কমানো এবং কার্বন ফুটপ্রিন্টস কমানোর দিকটা মাথায় রাখা হয়েছে।
বেইন জানায়, ই-কমার্স জায়ান্ট ফ্লিপকার্ট এবং ফুড ডেলিভারি জায়ান্ট জোম্যাটো হচ্ছে এমন দুটি কোম্পানি যারা ইতোমধ্যেই ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
উন্নতির সুযোগ
তবে এত প্রচারণা ও আগ্রহ থাকার পরেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এখনও মূল ৩টি চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।
ভারত এখনও চার্জিং অবকাঠামোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। কর্তৃপক্ষ এই অবস্থা বদলানোর জন্য কাজ করছে; দেশের ২৫টি রাজ্যে মোট ৬৮টি শহরের পাশাপাশি কয়েক ডজন হাইওয়ে ও এক্সপ্রেসওয়েতে নতুন চার্জিং নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে বলে দেশটির ভারী শিল্প বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জুলাইয়ে এক বিবৃতিতে জানানো হয়।
কিন্তু ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি দেশ, এর রয়েছে ২৮টি রাজ্য এবং হাজার হাজার শহর, সেইসঙ্গে প্রচুর অনুন্নত গ্রামীণ এলাকা।
তার মানে ভারতকে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে- এবং অনেক টাকাও ঢালতে হবে। গত বছরের নভেম্বরে ডব্লিউইএফ এর আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, ভারতের দুই ও তিন-চাকার গাড়ির বাজারকে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে রূপ দিতে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন ডলার দরকার।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ব্লুস্মার্ট-এর সিইও আনমোল সিং জাগগি বলেন, তারা বৈদ্যুতিক গাড়ির ছোট আকারের একটা বহর ব্যবহার করেন। তিনি চার্জিং স্টেশন কম থাকাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলে অভিহিত করেন।
"যদিও আমরা কিছু বৃহৎ সুপার হাব তৈরি করেছি... কিন্তু আমরা এখনও বড় পরিসরের চার্জিং অবকাঠামোর অভাবে সীমাবদ্ধতা বোধ করি। আমার মনে হয় সরকারের এ বিষয়ে আরও কাজ করার আছে", বলেন জাগগি।
কিন্তু ভালো ভর্তুকি দেওয়া সত্ত্বেও ভোক্তাদের একটা অংশ এখনো ইভি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেহেতু গ্রাহকেরা নিরাপত্তা, নির্ভরযোগ্যতা বা ব্যাটারিচালিত গাড়ির গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চায়, তাই এ বিষয়ে আরও শিক্ষা প্রয়োজন। আবার কোনো কোনো গ্রাহক মনে করেন, এই মডেলগুলোর দাম এখনো অনেক বেশি।
ব্রজেশ ছিব্বর বলেন, ইভির গুরুত্ব বুঝতে মানুষের আরেকটু সময় লাগবে। এর মাধ্যমে যেমন জ্বালানি বাঁচানো যায়, তেমনই রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম।
কিন্তু দুই-চাকার বাহন নির্মাতারা বলেন, ভারতে জ্বালানির উচ্চমূল্যের সময়ে, কমবাশন ইঞ্জিনের গাড়ি চালানোর খরচের তুলনায় ইলেক্ট্রিক স্কুটার বা মোটরসাইকেল কিনে লাভের মুখ দেখতে এক বছরেরও কম সময় লাগে।
"এখনো অনেকে সন্দেহে ভোগেন বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে। ভবিষ্যতে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লে, ব্যাটারির দাম কমে আসলে পুরো সমীকরণে ভারসাম্য আসবে", বলেন ছিব্বর।
কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তারাও এমনটাই ভাবছেন।
৪০০০ গাড়ির একটি বহর পরিচালনা করেন জাগগি। তিনি জানান, তিনি বহুদিন ধরে এই অনুমানের ওপরেই আশাবাদী যে 'ভবিষ্যতে ব্যাটারির দাম কমবে, তবে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা বাড়বে।' তার ভাষ্যে, "এটা আমাদের মতো তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করবে। এমন সুযোগ শতাব্দীতে একবার পাওয়া যায়।"