বালু কি পরবর্তী লিথিয়াম হয়ে উঠবে?
ইউক্রেন আক্রমণের পর ইউরোপে গ্যাস ও তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। এসময় ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা ছাড়া শীতকাল পার করা এবং গ্রীষ্মকালে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ছাড়া চলা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত ছিলেন।
তবে ক্রেমলিনের যুদ্ধকালীন এই কৌশলটি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তাপ সঞ্চয় করে এমন সস্তা এবং প্রচুর প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি ব্যাটারির ব্যবহার বাড়িয়েছে।
জ্বালানি 'ব্যাংক' হিসাবে বালু, লবণ, তাপ, বায়ু এবং অন্যান্য উপাদানের ব্যবহার বহু শতাব্দী পুরনো। প্রাচীন মিশরীয় বাড়ির দেয়াল দিনের বেলায় সৌর তাপ শোষণ করে এবং শীতল মরুভূমির রাতে সে তাপ ছেড়ে দেয় এবং ঘর উষ্ণ রাখে।
আর আমেরিকাজুড়ে আদিবাসীরাও একই কাজের জন্য নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে মাটি, পানি, খড় বা গোবরের মতো অন্যান্য জৈব উপাদানে তৈরি বিশেষ ইট ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
বিশ্বে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বালু ব্যাটারি তৈরি করা ফিনল্যান্ডের স্টার্টআপ কোম্পানি পোলার নাইট এনার্জির প্রধান নির্বাহী টমি ইরোনেন বলেন, আধুনিক শিল্প উন্নয়ন তাড়িত হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে। তবে প্রাকৃতিক উপাদান হতে পারে এক বৈপ্লবিক ভিত্তি। কারণ এতে কোন কিছু 'পুড়ে যায় না'।
প্রাকৃতিক ব্যাটারির মাধ্যমে সূর্যের আলো না থাকলেও এবং বাতাস প্রবাহিত না হলেও বায়ু টারবাইন এবং সৌর প্যানেল থেকে আসা জ্বালানি মজুত রেখে সরবরাহ করা যাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম জীবাশ্ম জ্বালানির দামের তুলনায় কম হলেও দীর্ঘমেয়াদী এবং সাশ্রয়ী মজুত সুবিধার অভাবে ধুঁকছে এই খাত। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ব্যাটারি হতে পারে সমাধান।
পোলার নাইট এনার্জি টেম্পেরে ও কানকানপা শহরে তাদের বালু ব্যাটারি সুবিধা স্থাপন করেছে। যেখানে স্টিলের চৌবাচ্চাগুলোয় বালু ১,০০০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইটে উত্তপ্ত করে রাখা হয়। এই সঞ্চিত জ্বালানি পাওয়ার গ্রিডের সরবরাহ নির্ঝঞ্চাট করতে সাহায্য করে। এবং ডিস্ট্রিক্টের হিটিং নেটওয়ার্কের ব্যাকআপ হিসেবে ঘর, অফিস এবং সুইমিংপুলগুলোকে উষ্ণ রাখে। এমনকি রাশিয়ান জীবাশ্ম জ্বালানীর সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার পরেও প্রত্যান্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ প্রবাহ অব্যাহত ছিল।
প্রাকৃতিক ব্যাটারি কীভাবে কাজ করে
পোলার নাইট এনার্জির প্রধান বিজ্ঞানী ভিলে কিভিওজা বলেন, বালুর ব্যাটারির কার্যকারিতা নিরীক্ষণ করা সেন্সর এবং ভালভগুলো উন্নত প্রযুক্তির। তবে এই ব্যাটারির নকশা খুবই সাধারণ।
আশেপাশে যে কোন জায়গা থেকে ট্রাকে করে বালু এনে একটি দৈত্যাকার চৌবাচ্চা বা 'ব্যাটারি'-তে এনে ফেলা হয়, যা ধারাবাহিকভাবে গরম তথা 'চার্জড' থাকে।
সৌর প্যানেল এবং বায়ু টারবাইন থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটি হিটার দ্বারা তাপে রূপান্তরিত হয়, যা বালু উত্তপ্ত করে। 'ব্যাটারি' হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম তাপের প্রবাহকে সঞ্চালন করে একটি ফ্যান ।
বালু কখনই ঠান্ডা হয় না, কারণ এটি বিশাল চৌবাচ্চায় তাপযুক্ত থাকে। এমনকি যখন ব্যাটারির 'চার্জ' কম থাকে, তখনো তাপমাত্রা ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে থাকে; আর যখন পূর্ণ হয়, এটি ১,০০০ ডিগ্রি অতিক্রম করতে পারে।
বালু কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে শক্তি ধরে রাখতে পারে। যেখানে বাজারে সবচেয়ে প্রচলিত লিথিয়াম ব্যাটারি মাত্র কয়েক ঘণ্টা ধরে রাখতে সক্ষম।
প্রাকৃতিক ব্যাটারি তৈরিতে নানা উদ্যোগ
সোলার ও বায়ু টার্বাইনের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সব সময় এক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। তাৎক্ষণিক ব্যবহার না হলে বেশিরভাগ সময় জ্বালানি কোনো কাজে আসে না। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ মজুত করাই উত্তম সমাধান।
তবে মোবাইল থেকে শুরু করে ল্যাপটপ ও অন্যান্য ইলেকট্রিক পণ্য চার্জ দিতে ব্যবহার করা লিথিয়াম ব্যাটারির সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো একসময় কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করে। এবং বিভিন্ন সময় বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে।
আবার লিথিয়াম ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনী পণ্য 'কোবাল্ট' খুঁড়ে বের করতে শিশুদের ব্যবহার করা হয়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এই খাতে প্রায় ৪০ হাজার শিশু শ্রমিক কাজ করে। যাদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে খুব সামান্য। এবং তারা কোনো ক্ষতিপূরণও পায় না।
পরিবেশগত ঝুঁকি ও মানবাধিকার হরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা ব্যাটারি রূপান্তরে অর্থ ঢালছেন। ২০২১ সাল থেকে সবুজ জ্বালানি সংরক্ষণ প্রযুক্তিতে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিনিয়োগ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে।
এই খাতে অন্যতম উদ্যোগ হলো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ব্যাটারি তৈরি। বিভিন্ন দেশে সরকারি এবং বেসরকারি খাত থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার পর অনেক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান জ্বালানি মজুতের নানা পন্থা সামনে আনছে।
ইতালির সার্ডিনিয়ায় মাল্টি-মেগাওয়াট কার্বন ডাই অক্সাইড ভিত্তিক ব্যাটারি রয়েছে, একই দেশের টাস্কানি শহরে একটি শিলা-ভিত্তিক স্টোরেজ সুবিধা তৈরি হয়েছে। একটি সুইস কোম্পানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও সঞ্চয় করতে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি বিশেষ ইট দিয়ে ২৩০ ফুট উঁচু ভবন তৈরি করছে। যে ইট-ই মূলত জ্বালানি সঞ্চয় করবে। অন্যদিকে ডেনমার্কের একটি স্টার্টআপ গলিত লবণ থেকে শক্তি সঞ্চয় করছে। প্রতিষ্ঠানটি তিন মহাদেশজুড়ে পরিত্যাক্ত কয়লা খনিতে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
ড্যানিশ টেক ইউনিভার্সিটির বিদ্যুৎ সঞ্চয় বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক কার্ট এঙ্গেলব্রেখ্ট বলেন, এগুলো আমাদের কাছে থাকা প্রাচীনতম প্রযুক্তি।
তিনি এবং তার সহকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে সহজ ও প্রাকৃতিক উপায়ে স্টোরেজ সমাধানগুলোকে একীভূত করার জন্য জাতীয় ডিকার্বনাইজেশন প্রোগ্রাম চালিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জ্বালানি সংকটের ফলে প্রাকৃতিক ব্যাটারির বিষয়টি প্রকৃত মনোযোগ পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রপ্তানি নিয়ে পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট ছিল পূর্ণ মনোযোগ আসার চূড়ান্ত পর্যায়।
প্রাকৃতিক ব্যাটারির ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা
ইতালীয় কোম্পানি এনার্জি ডোমের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউদিও স্পাদাচিনি বলেছেন, প্রাকৃতিক ব্যাটারিগুলি জীবাশ্ম জ্বালানি ছেড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি গ্রহণে উৎসাহী করবে। এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সময়ে ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশগুলোকে সাহায্য করবে।
তার কোম্পানি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিও২-ভিত্তিক ব্যাটারির সংস্করণ বিক্রির পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, সূর্য সর্বত্র আলো দেয় এবং বাতাস সর্বত্র প্রবাহিত হয়, এবং যদি আমরা ইতিমধ্যে বিদ্যমান উপাদানগুলি ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে সেই উত্সগুলিকে কাজে লাগাতে পারি, তবে এটি পাজলের অনুপস্থিত অংশ হতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সফল হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ব্যাটারিগুলিকে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো একই স্কেলের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। এটি অর্জন করা যায় কিনা তা দেখা এখনো বাকি।
গলিত লবণ-ভিত্তিক স্টোরেজ স্টার্টআপ হাইকের প্রধান নির্বাহী লভশাল-ইয়েনসেন বলেন, আধুনিক বিশ্ব যে মানদণ্ডে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সেই একই মান বজায় রাখা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। তার বিশ্বাস মাত্রই বিকাশের পর্যায়ে থাকা প্রাকৃতিক ব্যাটারি সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে সক্ষম হবে।