‘চাচা বলতেন টাকা নয়, ফুটবলের পেছনে দৌড়াও’
যাকে আদর্শ মেনে ফুটবলকে বেছে নেওয়া, সেই মানুষটি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কীভাবে কী হলো, জানাতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল কায়সার আহমেদ রাজিবের। বারবার কথা থামিয়ে দিচ্ছিলেন দীর্ঘ ১৫ বছর পেশাদার ফুটবল খেলা রাজিবের।
ক্রিকেট ও ফুটবল; দুই খেলাতেই ভালো ছিলেন রাজিব। কিন্তু চাচা এসএম সালাউদ্দিনের চাওয়া, ফুটবলার হতে হবে। বাবার সায়ও ছিল ফুটবলেই। আর কিছু না ভেবে ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলকে বেছে নেন রাজিব।
'চাচা যেসব ক্লাবে খেলেছেন, আমিও খেলব সেসব ক্লাবে' মনে মনে যেন এমনই পণ করে ফেলেন রাজিব। সে পথে অনেকটা সফলও তিনি। ২০১৬-১৭ মৌসুমে এসে কাকা সালাউদ্দিনের প্রিয় ক্লাব মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়েও খেলে ফেলেন রাজিব।
চাচাতো ভাইয়ের ছেলের মোহামেডানে খেলার খবরটি শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন শনিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার এসএম সালাউদ্দিন। এ কথা মনে করে এক রকম আহাজারিই করতে লাগলেন রাজিব।
কথা বলতে বলতে একজুন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারেন, এটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না রাজিবের। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে রাজিব বলেন, 'ঈদের দিন থেকেই কাকা অসুস্থ, হাল্কা জ্বর-কাশি ছিল। তিনদিনেও জ্বর না কমায় টেস্ট করান। শুক্রবার দুপুরের দিকে রেজাল্ট পাওয়া যায়। রেজাল্ট নেগেটিভ ছিল। এরপর উনি ঢাকার বাসা থেকে নারায়নগঞ্জের বাসায় চলে আসেন।'
জাতীয় দলের তিন বছর খেলা সালাউদ্দিন মানিসকভাবে শক্তিশালী ছিলেন জানিয়ে রাজিব বলেন, 'চাচা মানসিকভাবে বেশ শক্তিশালী ছিলেন। এসব খুব একটা গায়ে তুলতেন না। বলতেন এসবে কিছু না, আমি ঠিক আছি। রাতে উনার বোনদের সাথে আড়াইটা পর্যন্ত কথা বলেছেন। উনি সাধারণত এতো কথা বলতেন না, খুব কম কথা বলতেন। ওই রাতে বেশি কথা বলছিলেন।'
কীভাবে এসএম সালাউদ্দিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সেটা জানাতে গিয়ে রাজিব বলেন, 'ফজরের নামাজ পড়ার জন্য ওজু করার কথা বলছিলেন চাচা। তখন চাচি তার ছেলেকে ডাকছিলেন আর বলছিলেন যে "তোর বাবা ঘামাচ্ছেন।" তখনও চাচা বলছিলেন, "আমি ঠিক আছি।" কথা বলছিলেন তখনও, সুরা পড়ছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে কথার আওয়াজ কমে আসে। এভাবে আস্তে করে চোখটা বন্ধ করে ফেলেন।'
চাচার কারণেই মূলত ফুটবলে আসা রাজিবের। চাচাকে আদর্শ মেনেই প্রতিটা কদম ফেলেছেন তিনি। এসএম সালাউদ্দিন যেসব ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, বেশিরভাগ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন রাজিবও। পাইওনিয়ার ফুটবলে রেইনবো স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন রাজিব। এরপর খেলেছেন শেখ রাসেল, দীপালি যুব সংঘ, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে।
নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে চাচার অবদানের কথা জানাতে গিয়ে রাজিব বলেন, 'আমার ফুটবলে আসার পেছনে উনার অবদান অনেক। উনার উৎসাহের কারণেই আমার ফুটবলে আশা। চাচা বলতেন, "আমি চাই তুমি ফুটবল খেলো।" আমি ক্রিকেটও ভালো খেলতাম। ২০০১-০২ সালের ওই সময় ক্রিকেটের একটা জোয়াড় ছিল। কিন্তু আমার বাবা এবং এই চাচার কারণে ক্রিকেটে যেতে পারিনি। বাবা বলতেন "তোমার চাচা ফুটবল খেলেছেন, তুমিও ফুটবল খেলবে।"
ভাইয়ের ছেলেকে মোহামেডানে খেলতে দেখতে চাইতেন সালাউদ্দিন। শেষের দিকে এসে চাচার এই স্বপ্ন পূরণ করেন রাজিব, 'চাচা চাইতেন আমি মোহামেডানের হয়ে খেলি। শেষ পর্যায়ে এসে আমি মোহামেডানে খেললাম। কষ্ট লাগে এসব বলতে। মোহামেডানে খেলার পর চাচাকে বলি, চাচা এতটা খুশি হয়েছেন যে, বলে বোঝাতে পারব না।'
চাচার আদর্শেই জীবন গড়া লক্ষ্য ছিল রাজিবের। রাইট ব্যাক হিসেবে বিভিন্ন ক্লাবে খেলা ৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার বলেন, 'চাচা আমাকে একটা কথা সব সময় বলতেন, তুমি ফুটবলের পেছনে দৌড়াও, টাকা তোমার পেছনে দৌড়াবে। তুমি কখনও টাকার পেছনে দৌড়াবে না, তাহলে তুমি জীবনে কখনও উপরের পর্যায়ে যেতে পারবে না। তার কথাগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। আমি ১৫ বছর ফুটবল খেললাম। কাকা যেসব দলে খেলেছেন, মোটামুটি সবগুলো দলেই আমার খেলা হয়েছে।'
ফুটবলার সালাউদ্দিন মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, সেটাও জানালেন রাজিব, 'উনি শুধু ফুটবলার হিসেবে নন, মানুষ হিসেবেও দারুণ ছিলেন। আমাদের চারটা সমাজ আছে, উনি ছিলেন এই চার সমাজের উপদেষ্টা। উনি অনেকেরই জুনিয়র, উনার চেয়ে অনেকের বয়স বেশি ছিল। কিন্তু সবাই উনাকে মুরব্বির সম্মান দিতেন। উনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। উনার মৃত্যুর খবরে শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো এলাকা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।'