ইছামতি এখন ময়লার ভাগাড়
উত্তরবঙ্গের প্রাচীন জেলা শহর পাবনার বুক চিরে বয়ে চলা সেই স্রোতস্বিনী ইছামতি আজ জলশুন্য। সময়ের ব্যবধানে প্রমত্ত ইছামতী এখন শুধুই স্মৃতি। যৌবন হারিয়ে আজ তার অস্তিত্বই বিলীন।
তাঁত শিল্প আর কৃষিতে সমৃদ্ধ এ জেলাবাসীর এক সময়ের আশীর্বাদ ইছামতি আজ যেন মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের নাম। অব্যাহত দখল আর দূষণে এ নদী পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে।
প্রভাবশালীরা নদীর দুই পাড় দখল করে গড়ে তুলেছে কাঁচা পাকা স্থাপনা। মৃতপ্রায় ইছামতি নদী দেখে অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন ‘ময়লা আবর্জনার ভাগাড়’ বা ‘পৌরসভার ড্রেন’।
১৯৭০ এর দশকে ইছামতির প্রস্থ ছিল ১০০ থেকে ৩০০ ফুট। অথচ, অব্যাহত দখলে নদীর প্রস্থ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২৫ ফুটে। অধিকাংশ এলাকা ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। জেলা শহরের প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালীরা উৎসমুখ ভরাট করে ফেলায় এ নদী এখন পরিণত হয়েছে প্রাণহীন খালে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. আব্দুল আলীম জানান, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব ইসলাম খাঁর শাসনামলে সৈন্য পরিচালনার সুবিধার্থে পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপনে পাবনা মধ্য শহরে একটি খাল কাটেন। এই খালই পরে ইছামতি নাম ধারণ করে। এ নদীকে ঘিরেই গড়ে ওঠে পাবনা শহর।
এক সময়ের খরস্রোতা এই নদী দিয়ে চলতো নৌকা-ছোট জাহাজ। আর এই ইছামতি দিয়েই কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী থেকে শাহজাদপুরের কাচারি বাড়িতে যাতায়াত করতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘ইছামতী বাঁচাও’ আন্দোলনের আহবায়ক ফারুক হোসেন চৌধুরী বলেন, ইছামতীর দখল দূষণের কারণে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। বার বার নদী খননে উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও অদৃশ্য কারণে তা থেমে যায়। সামাজিক আন্দোলন, আইনী পদক্ষেপের মাধ্যমে কোন কিছুতেই প্রতিকার না পেয়ে এখন হতাশ পাবনাবাসী।
পাবনা প্রেসক্লাবের সাবেক সম্পাদক উৎপল মির্জা বলেন, নদীর দুই পাড়ের অনেক বাসিন্দা নদী দখল করে স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। এদের অনেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ইছামতীর বেহাল দশা দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। নদী অবৈধ দখলমুক্ত করে, পুণঃখননের কাজে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করারও দাবি জানান তিনি।
তবে, কর্তৃপক্ষ বলছেন, নদী খননে শুরু হয়েছে প্রকল্প প্রণয়ন। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে শীঘ্রই মাঠে নামবে প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, পাবনা বিভাগীয় অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম জহুরুল হক জানান, আমরা ইছামতী নদী পুনঃখননে আন্তরিক। সম্প্রতি ইছামতী নদী দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ সচল করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ দলের সহযোগীতায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই (ভিসিবিলিটি স্টাডি) সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প প্রণয়ন সম্পন্ন হলে নদী খননের কাজ শুরু হবে।
পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, বর্তমান সরকার দেশের সকল নদী উদ্ধার ও পানি প্রবাহ সচল করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ইছামতীর অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ,অচিরেই নদী কমিশন ও পানি উন্নয়নকে সাথে নিয়ে,অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে একাধিকবার নদী খননে উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও তার কোন বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায়নি। নদী উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে সংশ্লিষ্ট সকলকে আইনী নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতিও। এতেও কাজ না হওয়ায়, প্রশ্ন উঠেছে, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়েই।
হচ্ছে হবের হাঁক ডাকে সে সব প্রতিশ্রুতি আলোর মুখ দেখেনি আজও। আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাসের এ নদীকে ঘিরে তাই পাবনাবাসীর প্রশ্ন, ইছামতীর প্রাণ ফিরবে কবে?