জুতো
[নাসার ইব্রাহিম: ফিলিস্তিনি লেখক, ঔপন্যাসিক। জন্ম বেইত সাহুরে, ১৯৫৩। বেথলিহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন আ্যন্ড ডেভেলপমেন্ট। সমাজবিজ্ঞান লেবানিজ ইউনিভার্সিটি, বৈরুত।]
অধিকৃত এলাকা, ফিলিস্তিন।
হয়তো কেবলই বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, তবে এখন গল্প, মানে সবার গল্প হয়ে গেছে।
নাজার কেন রামাল্লায় যাবার গোঁ ধরেছিল জানত না কেউ। পরিস্থিতি সুবিধের নাÑমিলিটারি চেক পয়েন্ট, অসম্মান, পাহাড়-পর্বত আর আবর্জনায় তৈরি বাধা ডিঙিয়ে কষ্টকর যাত্রা। তবু দিনমজুরের গোঁ ধরেছে নিজার: কী একটা সমস্যা মেটাতে নাকি রামাল্লায় যেতেই হবে, না গিয়ে উপায় নেই। 'পথের ঝামেলা আমি সইব...আমরা তো অভ্যস্ত হয়েই বড় হয়েছি।...এসব আমাদের জন্যে এখন দস্তুর...এ ছাড়া আর কীই-বা করার আছে? কি জন্যে মরণ পর্যন্ত বসে থাকব?'
গাড়িতে চেপে বিদায় হলো ও। যেভাবেই হোক রামাল্লায় যেতে হবে।
পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এক কিলোমিটার পিচঢালা রাস্তা পেরিয়ে আরেক কিলোমিটার মাটির পথ পেরোয় গাড়িগুলো। পাহাড়ের দিকে তাকাল নিজার। চেক পয়েন্ট পেরোনোর একটা উপায় সব সময়ই পেয়ে যায় লোকে। সাইড রোডগুলো চেক পয়েন্ট, হাজারো বিধিনিষেধ, ক্লান্তি আর অসহায়ত্বকে ফাঁকি দেওয়ায় নিপুণ করে তুলেছে ওদের। ওদের ঘরবাড়ি, পথঘাট ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয় যখন, সব সময়ই পিঁপড়ের ঢিবির মতো বেরোনোর পথ, সমাধান মিলে যায়। ফাঁকি দেওয়া, খাপ খাওয়ানো আর সহ্য করার দারুণ প্রতিভা ওদের। দিনের পর দিন মুখ আর খুদে পায়ে মাটি খুঁড়ে মাটির কণাগুলো দূরে ফেলে আসে পিঁপড়ের দল। ছোট ছোট গর্ত খোঁড়ে ওরা, তবে সেটাই যথেষ্ট। এমনভাবে চলতে থাকবে যেন কিছুই হয়নি। হয়তো মিনিটখানেক পর স্বেচ্ছায় অথবা ভুলে ওদেরই কেউ একজন সেই গর্ত ধ্বংস করবে। পিঁপড়ের দল থামে, ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে শুঁড় নাড়ে, অবস্থা জরিপ করে, গর্তের চারপাশে ভিড় করে, তারপর ফের সামনে বেড়ে কাজে নামে।
মেঠোপথে লাইন ধরে কালো রেখায় চলছে লোকজন, মাটির ঢিবির মতো লাগছে। যুথবদ্ধ মানুষগুলো খোঁড়াচ্ছে, থামছে, আবার সামনে বাড়ছে। আবার পিছু হটছে। গন্তব্যে পৌঁছাতে যেকোনো জায়গা বেয়ে উঠে যাবে ওরা; দান্তের নরক পেরুবে। সোজা পথে একসাথে জড়ো হয়, চড়াই ভাঙে; আবর্জনার বাধা টপকায়। হয়তো এক ঘণ্টা পরেই বুলডোজারগুলো পাথর, মাটি আর সিমেন্টের চাঙরে ওদের পথ ধ্বংস করতে পারে। কালো জটলা থামে, ইতিউতি নজর চালায়, নিজেদের কষ্ট, অশ্রু, ঘামের কথা ভাবে। তারপরেও একটা পথের খোঁজ পায়, তৈরি করে, আবিষ্কার করে। এভাবেই চিরন্তন জেদ ধরে রাখে।
অন্যদের মতোই এগিয়ে চলছে নিজার। ক্রুদ্ধ, খিস্তি আউড়ে পিঁপড়ের পথ ধরে এগোচ্ছে। ওর পাজোড়া ক্ষতবিক্ষত। পড়ছে, আবার উঠছে। এক বুড়োর হাতে ভর দিয়ে দুজনে একসঙ্গে চড়াই বাইতে থাকে। রামাল্লায় পৌঁছাতেই হবে। তখন হয়তো রামাল্লায় যেতে চাওয়ার কারণ বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল ও। অবশ্য সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওখানে পৌঁছানো ছিল লক্ষ্যÑএকগুঁয়ে হওয়ার ক্ষমতা, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যাতে স্রেফ পৌঁছানোই একধরনের বিজয়, আর সেটাই যথেষ্ট।
ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে উত্তপ্ত, ধূলিধূসরিত সময়। বাধা, অস্ত্র, সৈনিক, পরিচয়পত্র যাচাই, প্রলম্বিত অপেক্ষা, খিস্তিখেউড় আর অপমান। সব মিশে যাচ্ছে বাকি সবকিছুর সাথে। এগোনো আর পিছোনোয় সমান দুর্গতি। পেছনে বাধা আর অসম্মান, সামনেও তা-ই। সে জন্য সামনেই চলেছে ও। পৌঁছানো, দুর্দশাকে পাশ কাটানো, ভেঙে পড়াকে অবজ্ঞা করাই কি একধরনের সহজ, স্পষ্ট সাম্য নয়? আস্ত একটা জাতি গলি খুঁজে পায়: প্রথম কথা, লেগে থাকা, নইলে মৃত্যু; এই যুক্তিকে টিকিয়ে রাখতেই যুক্তি লঙ্ঘন করে।
নিজের ভাবনায় মগ্ন নাজার ক্লান্ত পায়ে আশার পথ বেয়ে উঠছে। প্রতিটি টিলাই একেকটা বাধা, পার হতেই হবে। ওর একগুঁয়েমিকে পুষ্টি জোগাচ্ছে তাতে। প্রতিটি হাসি একধরনের প্রতিরোধ যেন ওই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তবে নির্ভেজাল হাসির মুহূর্তটিতেই সত্যিকারের খুশি থাকে ও।
এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়ি, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, এক চেক পয়েন্ট থেকে আরেক চেক পয়েন্ট ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে চলেছে ও। আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে অবশেষে একটা গাড়ির আসনে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ল ও। জানে না চারপাশে কী ঘটছে।
ভোর হওয়ার পর ছয় ঘণ্টা পেরিয়েছে, খুব বেশি সময় নয়, ভেবে হাসল ও। অনেকের তো কোথাও যেতে, কাক্সিক্ষত জিনিসের দেখা পেতে দশ ঘণ্টাও লেগে যায়। কালান্দিয়া শরণার্থীশিবিরের কাছে শেষ চেক পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছাল ও। যুদ্ধ জেতার আর মাত্র এক ধাপ বাকি।
পিচঢালা রাস্তায় দীর্ঘ গাড়ির সারি। গতি কমিয়ে একসময় দীর্ঘ সারির শেষ মাথায় থামল গাড়ি। দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে চারপাশ জরিপ করল ও। রাস্তার দুপাশে গাড়ির ফাঁকফোকরে ধূলির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকজন। নারী, শিশু, তরুণ আর বুড়ো, ফেরিঅলা, ছাত্র, গাধা। মানুষের কণ্ঠস্বর, চেঁচামেচি, কাকুতি। মানুষ, যন্ত্রণা আর আবর্জনা, আবেদন আর ধূলি, জীবনের ঘোরলাগানো মিশেল।
গাড়ি ছেড়ে সামনে এগিয়ে জনতার সাথে যোগ দিল ও। পেছনে খিস্তির তুফান জন্ম দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল একটা ঝকঝকে কালো গাড়ি।
রোদে মানুষের চাঁদি পুড়ছে। ঘাড় বেয়ে লোনা ঘাম গড়িয়ে পড়ে চোখে ধন্ধ লেগে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামনে এগোনো ছাড়া গত্যন্তর নেই।
অবিচল এগিয়ে চলছে নিজার। কানে আসছে টুকরো কথা: 'সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পাস না থাকলে কাউকেই ঢুকতে দেবে না।'
'পারমিট থাকুক চাই না থাকুক, রামাল্লায় যেতেই হবে। ফিরছি না আমি।'
চেক পয়েন্টের কাছে এসে সিমেন্ট ব্লকের সামনে দাঁড়াল ও। অল্প কয়েকজন সৈন্য ঘুরঘুর করছে। ওদের কারও কারও বয়স এমনকি আঠারো বছরও হবে না; এখনো গোঁফের রেখা দেখা দেয়নি। ওদের সামনে শত শত নারী-পুরুষ আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে। পাসের জন্যে সৈনিকদের নানাভাবে তোষামোদ করছে। কিন্তু নিষ্ফল: অনুনয়, কান্না, বয়স, অসুস্থতা, ইউনিভার্সিটির কোর্স, কিছুতেই ফায়দা হচ্ছে না...'না মানে না।'
চাপ আর ভিড় প্রবল হয়ে উঠেছে। এক সৈনিক গ্যাস বোমা ছুড়ল, চাপা শব্দে ভিড়ের ভেতর বিস্ফোরিত হলো ওটা। ছোটাছুটি শুরু করল লোকজন। কাশতে কাশতে জ্ঞান হারাল, কিন্তু ফায়দাহীন। না মানে না।
ফের আগে বাড়তে শুরু করল জনতা। সামনে বাড়ল নিজার। সিমেন্ট ব্লকের সামনে খানিক দাঁড়াল, তারপর সংকীর্ণ প্যাসেজের দিকে এগোল।
'অ্যাই তুমি, কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও!'
'আমি যেতে চাই।'
'পারমিট আছে?'
'না, পারমিট নেই।'
'তাহলে ফিরে যাও। নিষেধ আছে।'
'কিন্তু, মিস্টার, আমাকে যেতেই হবে। অনেক দূর থেকে এসেছি। জরুরি কাজ আছে।'
'পরোয়া করি না। নিষেধ আছে। ফিরে যাও, নইলে গুলি করব।'
'গুলি করতে চাইছ কেন? দেখতেই পাচ্ছ আমি নিরস্ত্র।'
'বললাম তো, নিষেধ আছে।'
ইতস্তত করল নিজার। ঘাড় ফিরিয়ে চোখের পাতার ধোঁয়াশার ভেতর দিয়ে পেছনে তাকাল, আবার চেষ্টা করল।
'ফিরে আসা পর্যন্ত আমার আইডি কার্ড রাখতে চাইলে, ধরো, এটা রাখো।'
'দরকার নেই। যাওয়া নিষেধ। আমার হুকুমই শেষ কথা।'
'কেন রে ভাই? আমার কাছে কি চাও? আমাকে রামাল্লায় যেতেই হবে।'
অনন্তে চোখ ফেরাল সৈনিক, তারপর ফের নিজারের চেহারার দিকে তাকাল। এবার একটু মজা করার, মশকরার সুযোগ পাওয়া গেছে। নিজারের কাছে পরিচয়পত্র চাইল সৈনিক। একনজর ওটার দিকে তাকিয়ে নিজারের দিকে ফিরল সে।
'শোনো, মাথা থেকে টুপি খুললে তোমাকে যেতে দিতে পারি।'
তীক্ষè চোখে সৈনিকের দিকে তাকিয়ে মাথার টুপি খুলে ছুড়ে দিল নিজার।
'এবার যেতে পারি?'
জোরে হেসে উঠল সৈনিক। জনতার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে টুপিটা উধাও হতে দেখল সে।
'শেষ হয়নি। আরও শর্ত আছে, যদি যেতে চাও।'
নিজার বুঝল প্রাথমিক ও চরম প্রত্যাখ্যানের বাধা ডিঙাতে পেরেছে। এবার দরাদরি শুরু করল ও।
'হ্যাঁ, আর কী চাও?' সৈনিককে জিজ্ঞেস করল।
'জুতো খুলে রেখে যেতে হবে। আমার কাছেই থাকবে ওগুলো, ফেরার পথে ফেরত নিতে পারবে।'
সৈনিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল নিজার। এটা রসিকতা, নাকি সৈনিক সিরিয়াস?
'সম্ভব না। এই গরমে ভাঙা কাচ আর আবর্জনার ভেতর হাঁটব কীভাবে...?'
'ঠিকাছে, তাহলে যেখানে ছিলে সেখানেই ফিরে যাও।'
মাথা নামিয়ে আড়চোখে তাকাল নিজার। প্রচণ্ড রোদ আর ধূলির মেঘ ভেদ করে জনতাকে জরিপ করল। চোখের পলকে গোটা জীবনের ভোগান্তি আবার জীবন্ত হয়ে উঠল।
'বেশ, মেনে নিলাম,' অবশেষে বলল ও।
উবু হয়ে জুতো খুলে চট করে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বিস্মিত সৈনিকের সামনে সিমেন্ট ব্লকে রাখল।
'আরে দাঁড়াও, শর্ত এখনো শেষ হয়নি।'
যেন ঘোরের ভেতর হাঁটছে নিজার। রোদে তেতে আছে মেঠোপথ।
'যাবার আগে এক কাপ চা এনে দাও আমাকে।'
একবার সৈনিকের দিকে, তারপর নিজের পায়ের দিকে তাকাল নিজার। গাল বেয়ে ঘামের ধারা নামছে, থুতনির কাছে ক্ষণিকের জন্যে ইতস্তত করে তারপর হারিয়ে যাচ্ছে উত্তপ্ত ধূলিতে।
ধীর পায়ে সরে এল ও। পাঁচ মিনিট বাদে বড় একটা গ্লাসে নিয়ে চা নিয়ে ফিরল। সৈনিকের হাতে দিল ওটা। অন্য সৈনিকদের সাথে রসিকতা করার ফাঁকে তাতে চুমুক দিতে লাগল সৈনিক।
চেক পয়েন্ট থেকে বিদায় নিল নিজার। অবশেষে ওটা পেরিয়ে রামাল্লার পথ ধরল। পেরিয়ে আসতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
(বয়ানের যুক্তিতে এখানেই গল্পটা শেষ হতে পারত। কিন্তু যথারীতি একজন সাধারণ ফিলিস্তিনি গল্পটাকে ভিন্ন সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে জোর করেছে।)
চার ঘণ্টা বাদে ফিরল নিজার। চেক পয়েন্টের কাছে যাওয়ার আগে নতুন জুতোজোড়া খুলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢোকাল ও। খালি পায়ে ফেরার শর্ত ছিল ওর।
চেক পয়েন্টের সৈনিকের দিকে এগিয়ে গেল ও।
'দেখ, আমি ফিরে এসেছি। আমার জুতো কই?'
সিমেন্টের চৌকো ব্লকে রাখা জুতোজোড়ার দিকে ইশারা করে প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সৈনিক।
জুতোর দিকে এগিয়ে গেল নিজার। ডান পা জুতোর ভেতর গলাতেই উষ্ণ তরলের ছোঁয়া পেল। চমকে পিছিয়ে এল ও। জুতোটা হাতে নিয়ে সৈনিকের দিকে তাকাল। আরও চারজন সৈনিক যোগ দিয়েছে তার সাথে, হাসছে। জুতো ওল্টাতেই কাদাময় হলদে তরল ঝরতে শুরু করল। বার কয়েক জুতোটা ঝাঁকিয়ে রাজনীতিক আর শীর্ষ সম্মেলনের নেতাদের ছবিতে ভরা খবর কাগজের পৃষ্ঠা দিয়ে মোছার চেষ্টা করল। শান্ত ভঙ্গিতে উঠে জুতোয় পা গলিয়ে চেক পয়েন্ট হয়ে বেরিয়ে এল ও। তিন কদম এগিয়েই আচমকা থমকে দাঁড়াল। ঘুরে আবার সিমেন্ট ব্লকের দিকে এগোল।
'কী চাই?' হাসিমুখ সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল সৈনিক।
নীরবে দাঁড়িয়ে রইল নিজার। মানুষ আর গাড়ির দিকে তাকাল। জুতো খুলে সিমেন্ট ব্লকে রেখে সরাসরি সৈনিকের চোখের দিকে তাকাল ও।
'শেষ একটা কথা বলতে চাই,' দৃঢ় কণ্ঠে বলল ও। 'যত দিন তোমরা আমাদের জুতোয় পেশাব করছ আর আর আমরা তোমাদের চায়ে পেশাব করছি, তত দিন আমাদের ভেতর শান্তি আসবে না। বুঝেছ?'
চট করে ঘুরে দাঁড়াল নিজার। নগ্ন পায়ে মিশে গেল ভিড়ে।