পেছনে হাঁটা যে কারণে উপকারী!
পেছনে না তাকিয়ে পেছনের দিকে হাঁটা! এতে কী লাভ? বরং মাটিতে পড়ারই সম্ভাবনা বেশি। তবে গবেষণা বলছে আশ্চর্য কথা! পেছনের দিকে হাঁটা শারীরিক স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্ক — দুটোর জন্যই দারুণ উপকারী।
অ্যাকাডেমিক দুনিয়ায় পেছনের দিকে হাঁটা রেট্রো-ওয়াকিং নামে পরিচিত। এর ইতিহাসটাও কিন্তু বেশ পুরোনো। ১৩ শতকের শুরুতেই মানুষ পেছনে হেঁটে কয়েকশ, ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক হাজার মাইল যাওয়ার কথা জানা গেছে। তখন কেউ উলটো হাঁটতেন বাজি ধরে, আর কেউ বা স্রেফ অদ্ভুত কোনো নতুন রেকর্ড তৈরির গর্বের লোভে।
তবে বায়োমেকানিক্সের পার্থক্যের কারণে পেছনের দিকে হাঁটার কিছু শারীরিক সুবিধা রয়েছে। পিঠের ব্যথা, হাঁটুর সমস্যা ও আর্থ্রাইটিস কমাতে ফিজিওথেরাপিতে এভাবে হাঁটার পদ্ধতি প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে এমনও দেখা গেছে যে, পেছনের দিকে হাঁটলে স্মৃতিশক্তি, রিয়্যাকশন টাইম ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতার মতো মস্তিষ্কের অবধারণগত সক্ষমতাগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ধারণা করা হয়, স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য পেছনের দিকে হাঁটার সূচনা প্রথম হয় প্রাচীন চীনে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমে খেলাধুলায় নৈপুণ্য বাড়ানোর ও পেশি শক্তিশালী করার উপায় হিসেবে এ ধরনের হাঁটা গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অভ নেভাদা'র বায়োমেকানিক্স বিশেষজ্ঞ জ্যানেট ডুফেক গত ২০ বছর ধরে পশ্চাৎমুখী হাঁটা নিয়ে গবেষণা করছেন। এক গবেষণায় তিনি ও তার সহ-গবেষকেরা দেখেন, দিনে কেবল ১০–১৫ মিনিট ধরে চার সপ্তাহ পেছনের দিকে হাঁটার পর ১০ নারী শিক্ষার্থীর হ্যামস্ট্রিংয়ের নমনীয়তা বেড়ে গিয়েছে।
রেট্রো-ওয়াকিং পিঠের পেশিকেও শক্তিশালী করে। ডুফেকের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট সময় এ ধরনের হাঁটার পর পাঁচজন ক্রীড়াবিদের কোমরের ব্যথা আগের তুলনায় কমে গিয়েছে।
বর্তমানে অনেক খেলার প্রশিক্ষণেই পেছনের দিকে হাঁটা ও দৌড়ানোর অনুশীলন করা হয়। এ ধরনের প্রশিক্ষণে হাঁটুর জোড়ায় চাপ কিছুটা কম তৈরি হয়, একই সঙ্গে হাঁটুর শক্তি বাড়ে। তাছাড়া রেট্রো-ওয়াকিং ক্রীড়াবিদদের আঘাত পাওয়া থেকেও রক্ষা করতে পারে।
শক্তপোক্ত ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি পশ্চাদ্হণ্টন বয়স্ক, তরুণ, স্থূলকায়, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও স্ট্রোকের রোগীর জন্যও উপকারী। এমনকি সামনে হাঁটার তুলনায় পেছনের দিকে হাঁটা বেশি শক্তি খরচ করে।
কিন্তু এমন অস্বাভাবিক হাঁটা কেন শরীরের জন্য এতটা উপকারী? ডুফেক বলেন, 'সামনে ও পেছনের দিকে হাঁটার বায়োমেকানিক্স একে অপরের চেয়ে খুবই ভিন্ন। পেছনের দিকে হাঁটলে হাঁটুর নড়াচড়া তুলনামূলক কম হয়। তাই অনেকের ক্ষেত্রে — এই যেমন ধরুন কেউ মাত্র হাঁটুর অস্ত্রোপচার থেকে সেরে উঠছেন, তার ক্ষেত্রে — এ ধরনের হাঁটা স্বাভাবিক হাঁটার চেয়ে বেশি উপকারী হতে পারে।'
হাঁটুসন্ধিতে চাপ পড়ার বদলে রেট্রো-ওয়াকিংয়ে গোড়ালির জোড়ায় চাপ বেশি পড়ে। ফলে পায়ের গোড়ালি আরও শক্তিশালী হয়। তবে শারীরিক এসব উন্নতির বাইরেও এমন হাঁটার আরও কিছু সুবিধা রয়েছে।
সামনের হাঁটার তুলনায় পেছনের দিকে হাঁটলে মস্তিষ্কের স্নায়ু কার্যক্রমের অবস্থানের ভিন্নতা লক্ষ্য করেছেন গবেষকেরা। মানুষের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানের মতো অবধারণগত দক্ষতাগুলো সামলায়। আর পেছনে হাঁটলে মস্তিষ্কের এ অংশ বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
নীল রংয়ের কালিতে লেখা 'লাল' শব্দটি — এমন দ্বান্দ্বিক উদ্দীপক ব্যবহার করে মস্তিষ্কের একটি পরীক্ষার নাম স্ট্রুপ টেস্ট। ডাচ একটি গবেষণায় ৩৮ জন অংশগ্রহণকারীকে এ ধরনের স্ট্রুপ টেস্ট করতে দেন গবেষকেরা। আর তাদেরকে এ পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় সামনে, পেছনের দিকে, এবাং পাশের দিকে হেঁটে।
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব অংশগ্রহণকারী পেছনের দিকে হেঁটে পরীক্ষাটিতে অংশ নিয়েছিলেন, তারা সবচেয়ে দ্রুত সময়ে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন। এর কারণ হয়তো তাদের মস্তিষ্ক ইতোমধ্যে পেছনের দিকে হাঁটার মতো বেখাপ্পা একটি কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে তারা দ্বান্দ্বিক এ পরীক্ষাতেও অন্যদের চেয়ে বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
আরেকটি গবেষণার ফলাফল আরও বিচিত্র। সেটিতে বলা হয়েছে, পেছনের দিকে বিভিন্ন প্রকার চলাচল — হোক সেটা পেছনের দিকে হাঁটা, পেছনের দিকে যাওয়া ট্রেনের ভিডিও দেখা, এবং এমনকি স্রেফ পেছনের দিকে যাওয়ার কল্পনা করা — গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের তথ্য মনে করার ক্ষমতাকে উন্নীত করেছে।
তবে রেট্রো-ওয়াকিংয়ের সঙ্গে কিছুটা ঝুঁকিও জড়িয়ে আছে। পেছনের দিকে হাঁটার সময় যেন কোনো কিছুতে ধাক্কা না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া এরকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে ফিজিওথেরাপির সময় পেছনের দিকে হাঁটতে গিয়ে ব্যক্তি পড়ে গিয়েছেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
আর রেট্রো-ওয়াকিংয়ের মতো সমান উপকার পাওয়ার আরও কিছু উপায়ও আছে বটে। যেমন চীনের গবেষকেরা দেখেছেন, ক্রীড়াবিদদের কোমরে ব্যথা কমানোর জন্য পেছনের দিকে হাঁটা, জগিংয়ের চেয়ে তাই চি ও সাঁতার অনেক বেশি কার্যকর।
রেট্রো-ওয়াকিংয়ের চেষ্টা করার আরেকটি কারণ বিষয়টির ভিন্নতা বলে মনে করেন জ্যানেট ডুফেক। 'হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট সারানোর আরও অনেক উপায় তো আছেই, কিন্তু সেটা যদি একটু মজা করে করা যায়, তা-তে ক্ষতি কী?' বলেন এ গবেষক।