ট্রান্স নারীদের জন্য ‘আশার আলো’ নিয়ে এলেন বাংলাদেশের বিউটি কুইন
বাংলাদেশি ট্রান্স নারী ইয়াসিন আহমেদ সকাল। তিনি সবসময় তার বোনেদের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা চাইতেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি তার রক্ষণশীল স্বদেশে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় করতালির সঙ্গে তাকে অভিবাদন জানানো হবে।
২৪ বছর বয়সি সকাল চলতি মাসে মিস এভারগ্রিন বাংলাদেশ ২০২৩ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানার আপ নির্বাচিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির মর্যাদাপূর্ণ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া কেবল সকালের ব্যক্তিগত অর্জনই নয়, বরং তার মতো আরো অনেকের জন্য একটি আশার বার্তাও।
সকাল—বাংলায় যার অর্থ 'ভোর'—ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্যাশন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
সকাল এএফপিকে বলেন, 'আশা করি আমি বাংলাদেশে ট্রান্স নারীদের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছি। এটি হাজারো ট্রান্স নারী এবং আমার মতো হাজার হাজার সকালের জন্য একটি বিজয়।'
বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আনুমানিক ১৫ লাখ মানুষ ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের পরিবার ও সমাজের কাছে নিগৃহীত বা পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনাগুলো খুবই সাধারণ, যা তাদের ভিক্ষাবৃত্তি বা পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়।
'সৌন্দর্যের কোনো লিঙ্গ হয় না'
সকাল বলেন, 'এটি সব বদ্ধ ট্রান্সজেন্ডারদের কাছে একটি আশার বার্তা। সেই বার্তাটি হলো সৌন্দর্য পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সৌন্দর্য সর্বত্র, বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যের কোনো লিঙ্গ নেই।'
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এদেশে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। যদিও এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় এখনও ব্যাপক আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের সম্মুখীন।
উপনিবেশিক যুগের দণ্ডবিধির অধীনে সমকামিতা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
সকালের বেড়ে ওঠা এক প্রতিকূল জগতে, যেখানে তার পুরুষ থেকে নারী হওয়ার ইচ্ছা উপহাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল।
সকাল এএফপিকে বলেন, 'আমি পুরুষ হয়ে জন্মেছি। কিন্তু আমি সবসময় উপলব্ধি করেছি যে আমি একজন নারী হিসেবে বেড়ে উঠেছি।'
রাজধানী ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার (৩৮ মাইল) পূর্বে অবস্থিত একটি গ্রামীণ মুসলিম পরিবারে জন্ম সকালের। তিনি ছোটবেলাতেই জানতেন শিশু হিসেবে তিনি ভিন্ন কিছু অনুভব করছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমি স্কুল-কলেজে বহুবার লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হয়েছি।'
সকাল 'লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে' কীভাবে একটি ইংরেজি কোর্সে ভর্তি হতে গিয়ে বাদ পড়েছিলেন সেই ঘটনাও উল্লেখ করেন।
সুন্দরী প্রতিযোগিতাটি ছিল কেবল নারীদের জন্য। প্রতিযোগিতায় সকালকে তার পুরুষের মতো নাম নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
সকাল বলেন, 'আমি সংশ্লিষ্টদের আমার পরিচয় বোঝাতে সক্ষম হওয়ার পরই আমাকে অডিশনের জন্য ডাকা হয়েছিল।'
তিনি বলেন, 'মিস এভারগ্রিন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়াটা আমি যে নারী তার প্রমাণ। প্রতিযোগিতার জন্য ধন্যবাদ, অবশেষে মানুষ আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছে।'
সকালকে যেখানে একজন ট্রান্স নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে অনেকেই তাকে 'হিজড়া' হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। 'তৃতীয় লিঙ্গ' বোঝাতে দক্ষিণ এশিয়ায় 'হিজড়া' শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২০১৩ সালে ট্রান্স ব্যক্তিদের আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পৃথক লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে তাদের ভোট দেওয়ার এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
দুই ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি মেয়র নির্বাচন করে জয়ীও করেন।
ইসলামী ধর্মগুরুরা ট্রান্স শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন, তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করেছেন।
'সেভাবে বাঁচো, যেভাবে আমি বাঁচতে ভালোবাসি'
সকাল বলেন, তিনি নিজেকে 'সৌভাগ্যবান মনে করেছিলেন'। তার পরিবার তাকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রতিযোগিতায় জয়লাভের পর যখন তাকে অভিনন্দনে ভাসানো হয় তখন তিনি 'অপরিসীম ভালবাসা' অনুভব করেন।
তিনি বলেন, 'তারা আমার অর্জনকে তাদের অর্জন বলে মনে করেছে।'
স্নাতক শেষে সকাল মডেল হতে চান এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চান।
তিনি বলেন, 'আমার স্বপ্ন, একদিন আমি একজন শীর্ষ মডেল হবো।'
জীবনের জন্য সকালের শিক্ষা হলো, তার কী হওয়া উচিত, সেটি বিরোধীদের ঠিক করে দেওয়াকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সকাল বলেন, 'যেভাবে আমি বাঁচতে ভালোবাসি, সেভাবেই সবসময় বাঁচার চেষ্টা করেছি। তাই ওসব লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আমাকে প্রভাবিত করেনি।'
সকাল বলেন, তিনি যা তার জন্য তিনি গর্বিত।
তিনি আরো বলেন, 'আপনি প্রকৃতির একটি রং পছন্দ না-ও করতে পারেন, কিন্তু সেই রংটিকে অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি নিজেকে প্রকৃতির একটি রং মনে করি এবং এই রং আমি পছন্দ করি।'