আনুষ্ঠানিকভাবে টাকার মান বাড়লেও, বাজারের প্রতিক্রিয়া বিপরীত
ডলারের তীব্র সংকটের মধ্যেও চলতি অর্থবছর মাত্র সাড়ে চার মাসে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৫.২৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর ফলে জুলাই থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলার। এটি ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি ও এক্সচেঞ্জ রেট কমানোর প্রয়োজনীয়তার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে ২৩ নভেম্বর এসে দাঁড়িয়েছে ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলারে।
এই পরিস্থিতিতে দুটি ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন টাকার মান ৫০ পয়সা বাড়ালেও তার ফল গেছে প্রত্যাশার বিপরীতে।
২২ নভেম্বর অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় দুই ক্ষেত্রেই ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমিয়ে ১১০ টাকা করার ঘোষণা দেয়; টানা এক বছর বাড়ার পর এবারই কমানো হয় ডলারের দাম।
আমদানিকারকদের জন্য ডলারের দাম ১১১ টাকা থেকে কমিয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ডলারের নতুন দাম ঘোষণার একদিন পর নতুন এক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুখপাত্র মেজবাউল হকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, বিদেশি ঋণ ও আমদানি কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে গেছে। এর ফলেই বেড়েছে টাকার মূল্যমান।
মেজবাউল হক আরও বলেছিলেন, তার ধারণা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বোঝা দ্রুত কমছে বিধায় ডলারের দাম আরও কমবে।
তবে, কার্ব মার্কেটে নির্ধারিত হারের রেটের চেয়ে প্রায় ২০ টাকা বেশি দরে রেমিট্যান্স ডলার বিক্রি হচ্ছে, অর্থাৎ দাম কমানোর তাৎক্ষণিক বাজার প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত।
নতুন রেট ঘোষণার মাত্র একদিন পর রেমিট্যান্স ডলারের দাম ১১৮-১১৯ থেকে বেড়ে ১২১-১২২ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।
একটি দেশ কখন তার মুদ্রার মান বাড়ায় জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশের মতো দেশ যারা অনেকটা ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট রেজিমে আছে, তাদের ক্ষেত্রে লোকাল কারেন্সি টাকার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু ইন্ডিকেটর ফলো করা হয়। যেমন, ফরেক্স রিজার্ভ স্ট্যাবল বা বাড়ছে কিনা এবং মার্কেটে ডলারের লিকুইডিটি বাড়ছে কিনা অর্থাৎ ডলারের সাপ্লাই ডিমান্ডের তুলনায় বেড়েছে কিনা। আমাদের দেশে এর কোনোটাই এখন নেই। আমাদের রিজার্ভ কমছে এবং মার্কেটে ডলারের লিকুইডিটি ক্রাইসিস আছে।"
ক্রমাগত টাকার মান কমানোর ট্রেন্ড থেকে বের হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, "প্রতি মাসেই ডলারের দাম বাড়ানোর কারণে সবার মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে ডলারের দাম আরো বাড়বে। ফলে বেশি দাম পেতে অনেকে ডলার স্টোর করা বা কিছুদিন পরে দেশে নিয়ে আসার চিন্তা করছে। ডলারের দাম কমানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ট্রেন্ডটাকে থামাতে চাইছে।"
"তবে এই দাম কমানোর পরদিনই আমরা দেখেছি রেমিট্যান্সের ডলারের দাম বেড়ে গেছে। মার্কেটে ডলারের ক্রাইসিস থাকলে এই ধরনেররিভ্যালুয়েশনের ইমপ্যাক্ট মার্কেটে খুব বেশি নাও হতে পারে," জানান তিনি।
এই মুহূর্তে টাকাকে রিভ্যালুয়েশন করার মতো অবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে আইএমএফ এর সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "এটা সত্যি যে কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্সের মতো আমাদের দেশের কিছু ফরেক্স ইন্ডিকেটর ভালো হয়েছে। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, মার্কেটে ডলারের ক্রাইসিস আগের তুলনায় বেড়েছে।"
"এক্ষেত্রে বাফেদার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের দাম কমানোটা মূলত মার্কেটকে একটা সিগন্যাল দেওয়া যে ডলারের দাম আর বাড়ানো হবে না। অবশ্য, সিদ্ধান্তটি যতোটা অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। নির্বাচনের আগে ডলারের দাম আর বাড়তে দিতে চাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক," বলেন তিনি।
এ অবস্থায় টাকার মান বাড়ানোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র নির্বাহী বলেন, তারা সাধারণ নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সংকেত দিতে চান।
এর আগে, ডলারের চাহিদা কিভাবে কমবে তা ব্যাখ্যা করার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বেসরকারি খাতের নেওয়া স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ কমেছে।
মেজবাউল হক বলেন, স্বল্পমেয়াদী ঋণের বিপরীতে মাসিক পরিশোধের পরিমাণ পরের বছরের সেপ্টেম্বরে মাত্র ৪৯.৮৭ মিলিয়ন ডলারে। এ বছরের অক্টোবরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের প্রথম আট মাসে ধার করা স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার চেয়ে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ এখন ১২.৪ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার উৎস উল্লেখ না করে শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধের সময়সূচী গণনা করেছে।
স্বল্পমেয়াদী ঋণের নীট ১২ বিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে সক্ষম হওয়ার জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকের ১৪ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের ফ্লো প্রয়োজন হবে।
চাহিদা ও যোগান উভয় দিকেই সমস্যার কারণে স্বল্পমেয়াদী ঋণের প্রবাহ কমছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, স্বল্পমেয়াদী ঋণ কমে যাওয়ায়, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ হওয়ায় রিজার্ভ থেকে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে।
রিজার্ভ এখন ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর হিসাব পদ্ধতিতে গণনা করা দেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিপিএম৬ হিসাব পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা করা হয়, যেখানে স্থানীয় বিনিয়োগকে বাদ রাখা হয়েছে।
একইসঙ্গে, গ্রস বা মোট রিজার্ভ বর্তমানে ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলার বলেও জানিয়েছে।
বিপিএম-৬ অনুযায়ী হিসাবকৃত সম্পূর্ণ রিজার্ভই ব্যবহারযোগ্য। অন্যদিকে বিনিয়োগকৃত অর্থ আদায় সাপেক্ষে গ্রস রিজার্ভও ব্যবহারযোগ্য।
সে হিসাবে, মোট ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হচ্ছে ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার।