ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গোপসাগরে পরীক্ষামূলক টুনা মাছ ধরার উদ্যোগ মৎস অধিদপ্তরের
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গোপসাগরের এক্সক্লুইভ ইকনোমিক জোন (একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল) ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনাসহ অনুরূপ পেলাজিক মাছ ধরা শুরু করার পরিকল্পনা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।
বঙ্গোপসাগরের ১.১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন থাকলেও বাংলাদেশ ১০০ মিটার গভীরতায় মাত্র ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের চারটি অঞ্চল থেকে মৎস সম্পদ আহরণ করে। ফলে ২০০ মিটার গভীরতায় টুনা এবং সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ থেকে গেছে অধরা।
এই সামুদ্রিক অঞ্চলে কোনো জরিপ না থাকায় টুনা ফিশ আহরণে অন্তত ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েও এই মাছ আহরণ কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী করতে এবার মৎস অধিদপ্তর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে টুনা ফিশ আহরণ এবং জরিপের উদ্যোগ নিয়েছে।
টুনা ফিশ আহরণের পরীক্ষামূলক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিনিয়োগকারীরা টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে এগিয়ে আসবে– এমনটি আশা করছে মৎস অধিদপ্তর।
সামনের বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীন থেকে ২৪ কোটি টাকায় দুটি জাহাজ আমদানি করে গভীর সাগরে টুনা ফিশ আহরণ কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রাথমিকভাবে ৩০ জন ক্রু নিয়োগ দেওয়া ও প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানিকতা শেষে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাহাজ দুটির অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক টিবিএসকে বলেন, "বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টুনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে ক্যানজাত টুনা আমদানি করা হয়। টুনা ফিশ আহরণের এই প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে সামুদ্রিক মৎস আহরণ খাত তথা ব্লু ইকোনোমিতে নতুন দ্বার উম্মোচিত হবে। জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টুনা ফিশ রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।"
মৎস অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে জুলাই ২০২০ হতে ডিসেম্বর ২০২৩ সময়ে গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। ৬১ কোটি ৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের আওতায় তিনটি জাহাজ কেনার কথা থাকলেও ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান সংকটের কারণে এখন দুটি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, প্রকল্পের মেয়াদ ১৮ মাস বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। ব্যয় প্রথমে ৬১ কোটি ৬ লাখ টাকা ধরা হলেও একটি জাহাজ কম কেনায় প্রকল্পের ব্যয় নেমে আসে ৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকায়।
প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাহাজ না কেনার বিষয়ে গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্পের পরিচালক জোবাইদুল আলম টিবিএসকে বলেন, "ডলার সংকটের কারণে ২০২২ সালের জুলাই থেকে জলযান এবং আকাশযান কেনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা এখনো চলমান। তবে সরকারের বিশেষ অনুমোদনক্রমে এই প্রকল্পের অধীনে দুটি জাহাজ কেনা হচ্ছে।"
জাহাজ দুটি চীনের ইউনি মেরিন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে কেনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সামুদ্রিক মৎস দপ্তরের তথ্য মতে, ইন্ডিয়ান ওশান অধ্যুষিত অঞ্চলে টুনা ফিশ আহরণ নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের অধীনে। এই কমিশনের অধীনে রয়েছে ৩০টি দেশ। বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল এই কমিশন এর সদস্যভুক্ত হয়। নিজেদের এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিয়মিত টুনা ফিশ আহরণ করে বাংলাদেশের কাছাকাছি অঞ্চলের ভারত, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ।
সামুদ্রিক মৎস দপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ইন্ডিয়ান ওশান টুনা ফিশ কমিশন বাংলাদেশের ফোকাল পার্সন মো. শওকত কবির চেীধুরী টিবিএসকে বলেন, টুনা ফিশ আহরণ করতে দেশের জলসীমার ২০০ মিটার গভীরতায় জরিপ চালানো হবে। এছাড়া ইন্ডিয়ান ওশানের আন্তর্জাতিক জলসীমায়ও টুনা ফিশ আহরণ করা হবে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে
তিনি আরও বলেন, "ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের সাথে টুনা ফিশ আহরণের বাংলাদেশের হিস্যা কী পরিমাণ হবে, সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে নেগোসিয়েশন চলছে। টুনা ফিশ আহরণে বাংলাদেশকেও উৎসাহ দিচ্ছে কমিশন।"
৮ প্রজাতির টুনা রয়েছে বঙ্গোপসাগরে
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে আট প্রজাতির টুনা এবং ১০টিরও বেশি প্রজাতির পেলাজিক মাছ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই খাতের উদ্যোক্তারা টুনা মাছ ধরায় নিয়োজিত হতে পারেননি না।
২০১৯ সালে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১৯টি কোম্পানিকে টুনা মাছ ধরার অনুমতি দেয়। তবে কোনো কোম্পানিই এ খাতে বিনিয়োগ করেনি। নতুন প্রকল্পটি সাগরের ২০০ মিটার গভীরতা থেকে টুনা মাছ ধরার জন্য লংলাইন ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জোবাইদুল আলম টিবিএসকে বলেন, " কী পরিমাণ মাছ ধরা যাবে, তা কেবল কার্যক্রম শুরু হলেই বলা যাবে। যেহেতু ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে টুনা এবং পেলাজিক মাছ ধরে, তাই আমরাও এই উদ্যোগকে সফল করার পরিকল্পনা নিয়েছি।"
বর্তমানে গভীর সাগরের চারটি অঞ্চল— সাউথ প্যাচেস, সাউথ অফ সাউথ প্যাচেস, মিডল গ্রাউন্ড এবং সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে মৎস আহরণ করা হয়। সমুদ্র উপকুল থেকে এসব অঞ্চলের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১৮ ঘণ্টা।
দূরত্ব অন্যতম চ্যালেঞ্জ
টুনা ফিশ আহরণ করতে বাংলাদেশের স্থলভাগ থেকে প্রায় ৩৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভারত ও শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি এলাকায় যাওয়া লাগবে। এ অঞ্চলে যেতে সময় লাগবে কমপক্ষে তিন দিন। তবে নিকটবর্তী হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের জেলেরা এ অঞ্চলে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছাতে পারে।
মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক বলেন, "সাগরে টুনা ফিশ আহরণে সরকার আমাদের প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু দেশের জলসীমায় কী পরিমাণ টুনা ফিশ আছে, কোন অঞ্চলে আছে– এ সংক্রান্ত কোনো জরিপ নেই। তাই আমরা আশাবাদী হতে পারিনি। তাছাড়া, টুনা ফিশ আহরণে প্রতিটি জাহাজে ৮০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া বিনিয়োগকারীরা এই খাতে এগিয়ে আসতে পারেনি।"
তিনি জানান, "এ সংক্রান্ত একাধিক সভা হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে এই খাতে সহজশর্তে ঋণ সুবিধা চেয়েছি। এটি করা গেলে টুনা ফিশ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সম্ভবনা তৈরি হবে।"
বেসরকারি খাতের অনিহা
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএফএ) প্রেসিডেন্ট নূরুল কাইয়্যুম খান টিবিএসকে বলেন, সরকার টুনা ফিশ আহরণে দুই দফায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দিলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসেনি।
"সেখানে কী পরিমাণ টুনা ফিশের মজুদ আছে, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই খাতের একটি জাহাজ আমদানি করতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লাগবে। সরকারের এই পাইলট প্রকল্পটি সফল হলে অবশ্যই বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসবে," বলেন তিনি।
মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বর্তমানে ২৬৩টি নিবন্ধিত ফিশিং জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ২৩০টি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে মৎস আহরণ করে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় ৬৭ হাজার নৌকা মৎস আহরণ করে।
মাত্র ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত তিনটি অঞ্চল থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে বাংলাদেশ। বার্ষিক মাছ ধরার পরিমাণ ৬.৫ লাখ টন।
মালয়েশিয়া থেকে আনা গবেষণা জাহাজ 'আরভি মীন সন্ধ্যানি' বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যেই ২৫ প্রজাতির মাছের প্রজননের সময় সম্পর্কে জানতে পেরেছে। তবে উপসাগরে অন্যান্য ৪৭৬ প্রজাতির মাছ ও ৩৯ প্রজাতির চিংড়ির প্রজনন সময় এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।