মোর্চা, জোট আর আসন ভাগাভাগির নির্বাচন
কান পাতলে শোনা যায়, নির্বাচনের গল্প। গণমাধ্যমে নিত্যদিনের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে– নির্বাচন। যদিও দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বদানকারী একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছে– নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে।
ভারতীয় উপমহাদেশের নির্বাচন পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়েছিল– ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গর্ভ থেকে। ব্রিটিশরা তখন ভারত শাসন করছে। যদিও তখনও সকল মানুষের ভোটের অধিকার ছিল না, এবং প্রথম ওই নির্বাচনে সীমিত সংখ্যক মানুষ ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কেবলমাত্র চৌকিদারী খাজনা প্রদানকারীরাই ভোটার হতে পেরেছিল।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ভারত শাসন আইন পাশ হয় ১৯৩৫ সনে। সে আইনের আওতায় প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। সেই নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব দেখা যায়– তাদের মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস– আজও যারা পাকিস্তান ও ভারতের রাজনীতিতে টিকে আছে।
সেই সময় নির্বাচনে মুসলিম লীগ একমাত্র প্রদেশ বাংলায় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়েছিল; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে মুসলিম লীগের সমর্থন নিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি সরকার গঠন করেছিল। স্বল্প সময়ের সেই সরকার ১৯৩৯ সনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত টিকে ছিল। তারপর নানান পথ পরিক্রমায় নতুন নতুন মোর্চা গঠন করে বাংলার সরকার পরিচালিত হচ্ছিল। সেই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিতে জোটের সন্ধান পাওয়া যায়। সরকার গঠনের জোট, সেই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়।
এরপরের নির্বাচনের সন্ধান পাওয়া যায়– ১৯৪৬ সালে। ভারত বিভক্তির পূর্বে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে এ নির্বাচন হয়েছিল সর্ব-ভারতীয় আঙ্গিকে। ফেডারেল শাসন কাঠামোর ভারত গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান পরিষদ গঠিত হয় সেই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। সেসময় নির্বাচন অংশ নেওয়া দলগুলো নিজ নিজ দলীয় নামেই নির্বাচন করেছিল।
সর্বভারতীয় আঙ্গিকে নির্বাচন সীমাবদ্ধ ছিল– মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্য। নির্বাচনে ভয়াবহ পরাজয় হয়েছিল মুসলিম লীগের। সাংবিধানিক পরিষদের ৩৮৯টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৭৩টি আসন।নির্বাচনের ফলাফল ভারত বিভাগের রাস্তাকে সুপ্রশস্ত করেছিল।
এরপরে প্রথম নির্বাচনে হয় পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে, ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫৩ সনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান ও ভারতের সেই নির্বাচনগুলো প্রথম দিকে কোন মোর্চার মাধ্যমে হয়নি। দলগুলো প্রধানত নিজেদের একক সক্ষমতায় নির্বাচন করেছিল। পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের কিছু ঘটনা আছে, যেখানে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পরস্পরের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছিল।
আমাদের এই ভূখণ্ডে প্রথম নির্বাচনের ইতিহাস ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। যে নির্বাচন প্রথম মোর্চা গঠিত হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে, অপর তিনটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী মোর্চা গঠন করে একই প্রতীকে নির্বাচন করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই প্রথম নিজ দলীয় প্রতীক ত্যাগ করে দলগুলো আওয়ামী মুসলিম লীগের নৌকার জোয়ারে ভেসেছিল, ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে। সেই চুয়ান্নর নির্বাচনের পরেই অন্য তিনটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে থাকে, এবং নৌকার যাত্রীরা তাদের নিজ দলীয় পরিচয় হারিয়ে বিলুপ্তির পথে হাঁটতে থাকে এবং শরিক দল তিনটি মাত্র ১৫ বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ভারতে জোট রাজনীতির সন্ধান পাওয়া যায় প্রথম কেরালা রাজ্যে ১৯৫৯ সালে। কিন্তু, সেই জোট গঠিত হয়েছিল কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিপক্ষে। কেরালার বামপন্থী ছোট ছোট দলগুলো মিলিত হয়ে সে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এভাবেই প্রথম অকংগ্রেসীয় মুখ্যমন্ত্রীর জন্ম দিয়েছিল কেরালা রাজ্য। রাজ্যের সেই জোট রাজনীতিতে সবগুলো দল তার নিজের নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার করেছিল, অর্থাৎ জোট কোনো একক প্রতীকে নির্বাচন করে নাই। কেরালার সেই জোট নির্বাচনে জয়লাভ করেন সিপিআইয়ের নেতা নান্বুদ্রপাদ।
এরপরে জোটের সন্ধান পাওয়া যায় পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে ১৯৬৭ সালে। এতে অকংগ্রেসীয় জোটের হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়। এরপরে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে কিংবা পাকিস্তানের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতি দেখা গেছে বহুবার। কিন্তু, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মতন একক প্রতীকে নির্বাচন করার ইতিহাস ভারত ও পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়নি। যখনই জোটভুক্ত হয়েছে দলগুলো তখনই তারা নিজ নিজ প্রতীকেই নির্বাচন করেছে। নিজস্ব প্রতীক ত্যাগ করে নির্বাচনের ফসল নেতারা ঘরে তুলেছেন বটে, কিন্তু পরিণতিতে এই দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে জোটভুক্ত দলগুলো নিজস্ব প্রতীক হারিয়ে তাদের ভবিষ্যতের পথকে রুদ্ধ করেছে।
যেমন ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের করেছে যে দলগুলো, সেসব দলের বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কোন অস্তিত্ব নেই। ওই দলগুলোর নামও আজকের প্রজন্ম জানে না। রাজনীতিবিদরাও সঠিকভাবে বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে ।
১৪ দল গঠনের ভেতর থেকে এই জোটবদ্ধ রাজনীতির নতুন ধারণা ২০০৯ সালে প্রথম সামনে আসে। অর্থাৎ, একই প্রতীকে নির্বাচন করা। যদিও ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট, বিএনপি ও জামাত ইসলামী নির্বাচন করেছিল, কিন্তু জামাত ও ইসলামী ঐক্য জোট নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করেছিল তখন। এবং সেই নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক বাদ দিয়ে নৌকা প্রতীকের অধীনে নির্বাচনে যোগদান করে যে বামপন্থী দলগুলো, সেই দলগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির খাতায়। এখন আওয়ামী লীগের কাছে তারা নৌকা প্রতীক নেওয়ার জন্য রীতিমতো কান্নাকাটি করেছে, এ খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি কৌশল হিসেবেই বিভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, এমনটি চাচ্ছিল। দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল যেহেতু নির্বাচন থেকে বিরত রয়েছে– সেই কারণে এবারের নির্বাচন যেন বিতর্কিত নির্বাচন না হয়– সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে দলীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় মনোনয়ন না পেলেও দলীয় নেতা-কর্মীরা, নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে।
বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল– জাতীয় পার্টি একই ধারায় হাঁটছে; যদিও তারা সব সময় নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে। তারপরেও এবারের নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন না হয়– সেই লক্ষ্যে আসন কিংবা বিপরীত প্রার্থী বিষয়ক আলোচনা-পর্যালোচনা করছে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিশালী প্রার্থী যেন তাদের আসনে না থাকে এমনটি তাদের প্রত্যাশা। সর্বশেষ অবস্থা দাঁড়িয়েছে: আসন ভাগাভাগির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ মোট ৩২টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ১৪ দলের শরিকদের জন্য ৬টি, আর জাতীয় পার্টির জন্য ২৬টি আসন ছেড়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।