তিন বলে তিন: মনে হয় অনেক বড় কিছু করেছি
বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হতেই বৃষ্টির হানা। বেশ কিছুক্ষণ বিরতির পর খেলা শুরুর সবুজ সংকেত আম্পায়ারদের। কিন্তু সময় গচ্ছা যাওয়ায় নিউজিল্যান্ডকে দেওয়া হয় নতুন লক্ষ্য। বাংলাদেশ ৪৯.৫ ওভারে ১০ উইকেটে ২৬৫ রান তুললেও বৃষ্টি আইনে কিউইদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২০৬ রান।
যা ৩৩ ওভারে পাড়ি দেওয়া খুব একটা কষ্টসাধ্য ছিল না সফরকারীদের জন্য। যদিও শুরুটা ভালো না হওয়ায় এই রানই একটা সময় দূরের পথ মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোরি অ্যান্ডারসনের দাপুটে ব্যাটিংয়ে ক্রমেই জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল নিউজিল্যান্ড। উইকেট ছিলেন মারকুটে ব্রেন্ডন ম্যাককালামও।
মাত্র ৩৬ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ডধারী কোরি অ্যান্ডারসন তখন ৩১ বলে ৪৬ রানে ব্যাটিং করছেন। এমন সময় বোলিংয়ে আসেন রুবেল হোসেন। ২৪তম ওভারের তৃতীয় বলে কোরি অ্যান্ডারসনের স্টাম্প উপড়ে নেন বাংলাদেশের ডানহাতি এই পেসার। পরের বলে ম্যাককালামকেও সাজঘর দেখিয়ে দেন তিনি।
এরপরই স্বপ্নের হ্যাটট্রিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। রুবেলের লেগ স্টাম্পের ওপরের ডেলিভারিটি জিমি নিশামের ব্যাট ছুঁয়ে জমা হয় উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসে। কিউইদের ব্যাটিং লাইপ আপ ছত্রখান করে হ্যাটট্রিকের বুনো আনন্দে মেতে ওঠেন রুবেল।
২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর মিরপুরে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে শুধু হ্যাটট্রিকই নয়, মাত্র ২৬ রান খরচায় ৬ উইকেট নেন রুবেল। যা বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা বোলিং ফিগার (যৌথভাবে সেরা, মাশরাফি বিন মুর্তজারও ২৬ রানে ৬ উইকেট)।
হ্যাটট্রিক, সেরা বোলিং ফিগার, ম্যাচসেরা; দিনটা নিজের করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৃতীয় বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করা রুবেল। সেই দিনটার কথা মনে পড়লে এখনও একবার তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন তিনি। মনে মনে ভাবেন, 'অনেক বড় কিছুই করেছি।'
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনের পঞ্চম পর্বে আজ থাকছেন রুবেল হোসেন। সেই ম্যাচের অনেক কিছু নিয়েই কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই পেসার। তার মুখেই শোনা যাক সে গল্প।
রুবেল হোসেন: হ্যাটট্রিক তো হ্যাটট্রিক। ওই ম্যাচে অবস্থা তখন ভালো ছিল না আমাদের। সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ছিল। বৃষ্টির কারণে ওভার কমিয়ে আনা হয়েছিল। ওই সময়ে উইকেটে ওদের ভালো ভালো ব্যাটসম্যান ছিল। ওই সময়টা আমাদের জন্য কঠিন অবস্থা ছিল। জিমি নিশাম, কোরি অ্যান্ডারসন, ম্যাককালাম ছিল। কোরি অ্যান্ডারসন খুব ভালো ছন্দে ছিল, মারছিল খুব।
আমার মনে হয় আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েছিলাম। এ ছাড়া উইকেটটা আমার পক্ষে ছিল। বৃষ্টির কারণে বল ভালো গ্রিপ করছিল, লাফাচ্ছিল। আমি চেষ্টা করেছি ভালো জায়গায় বল করার, তো হয়ে গেছে। হ্যাটট্রিক আলাদা একটা ব্যাপার। এটা সব সময় আপনি করতে পারবেন না।
হ্যাটট্রিক দারুণ ব্যাপার। ক্যারিয়ারে অলঙ্কার যোগ করে। আমি আগেই হ্যাটট্রিক করি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হ্যাটট্রিক থাকা আসলেই অন্যরকম ব্যাপার। আবার যদি দল জেতে, তাহলে আরও ভালো লাগা কাজ করে।
আমার হ্যাটট্রিকের কারণে ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। এ কারণে হ্যাটট্রিকটা আমার কাছে আরও বেশি স্মরণীয়। এ ছাড়া সিরিজের প্রথম ম্যাচ ছিল। আমরা ম্যাচটা জিতেছিলাম। হ্যাটট্রিকটার কথা মনে পড়লে খুবই ভালো লাগে, আনন্দ হয়।
দিনটা আমার ছিল বলাই যায়। হ্যাটট্রিকসহ ৬ উইকেট নিয়েছিলাম। ওই ৬ উইকেট আমার ক্যারিয়ারের সেরা। সেরা বোলিং ফিগার ওটা আমার। আমি যতটুকু জানি ২৬ রানে এরআগে ৬ উইকেট শুধু মাশরাফি ভাইয়ের আছে বাংলাদেশ থেকে। মাশরাফি ভাই আর আমার একই ফিগার। ৬ উইকেট নেওয়া, বাংলাদেশের সেরা বোলিং ফিগার, ম্যাচ জেতা, সেই ম্যাচে আমার অবদান ছিল; সব মিলিয়ে খুবই ভালো লাগে।
হ্যাটট্রিকের ব্যাপারটা অবশ্যই গর্বের বিষয়। এখনও অনুভব করতে পারি। তবে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিটা ম্যাচ প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য গর্বের বিষয়। কারণ দেশের হয়ে খেলা মানে অনেক বড় কিছু, আমি সব সময়ই সেটা মনে করি। ওই ম্যাচের বলটা এখনও আমার কাছে আছে, স্মরণীয় হয়ে আছে।
ওই সময় কোরি অ্যান্ডারসন খুব মারছিল। আমরা তো জানি ও কেমন ব্যাটসম্যান। ও একাই একটা ম্যাচের চিত্র পাল্টে দিতে পারে। ম্যাককালাম বা জিমি নিশামও তেমনই। তো কোরি অ্যান্ডারসনের উইকেটটা যখন পেলাম, ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল ম্যাচটার মোড় ঘুরে যেতে পারে। এরপর ম্যাককালামের উইকেট পেলাম। তখন আমি উইকেট নেওয়ারই চেষ্টা করেছি।
রান চেক দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তখন আমি আক্রমণ করার চেষ্টা করেছি। তখন আমি আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিলাম। ম্যাককালামের বলটা হাল্কা গ্রিপ করেছিল, লাফ দিয়েছিল। যে কারণে হয়তো ও বলটা সেভাবে বুঝতে পারেনি। যখন দুই উইকেট পেয়ে গেলাম, তখন চিন্তা করছিলাম যে আল্লাহ যদি হ্যাটট্রিকটা দিয়ে দেন, খুব ভালো হয়।
যদিও হ্যাটট্রিকের বলটা তেমন ভালো ছিল না। বলটা লেগ স্টাম্পে ছিল। মুশফিক ভাই খুব ভালো ক্যাচ নিয়েছিলেন। আমি ভাগ্যবান ছিলাম, হয়তো আল্লাহ আমার কপালে লিখে রেখেছিলেন হ্যাটট্রিকটা হয়ে যাবে।
প্রতিটা বোলারের জন্য হ্যাটট্রিক স্পেশাল। যে ব্যাটসম্যানকেই আউট করে সেটা হোক না কেন। তারপরও নিজের কাছে বেশি ভালো লাগে যখন বিশ্বের অন্যতম আক্রমণাত্মক বা জনপ্রিয় ব্যাটসম্যানকে আউট করে হ্যাটট্রিক হয়। আমার হ্যাটট্রিকে তিনজনই তেমন।
ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, কোরি অ্যান্ডারসন ও জিমি নিশাম; তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে একটি ম্যাচের চিত্র পাল্টে দিতে পারেন। তারা বিগ হিটার। তো এমন তিনজনের উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিক করা একটু বেশিই স্পেশাল। যখন আমি চিন্তা করি, বা কেউ জিজ্ঞাস করেন, তখন মনে হয় আসলেই অনেক বড় কিছু করতে পেরেছি।
হ্যাটট্রিক করাটা একজন বোলারের কাছে স্বপ্ন। আমারও ওই রকমের স্বপ্ন ছিল। ওই সময় আমি দলের অন্যতম প্রধান বোলার ছিলাম। আমিও চাইতাম হ্যাটট্রিক করতে। অনেক বোলারকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করতে দেখেছি। আমি স্বপ্ন দেখতাম। আল্লাহর রহমতে সেদিন হয়ে গেছে। তো এটা তৃপ্তির জায়গা যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমারও একটা হ্যাটট্রিক আছে।
কোনো সাংবাদিক, বন্ধু, বড় ভাই যখন আমার সেরা বোলিংয়ের কথা বললে আমি অ্যাডিলেটের কথা বলি (২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৩ রানে ৪ উইকেট)। ওটা আমার কাছে সেরা পারফরম্যান্স। আর কয়েকটা সেরার মধ্যে আমরার হ্যাটট্রিকটা অন্যতম। এটাকে আমি দুই নম্বরে রাখব। অ্যাডিলেটেরটা যেহেতু বিশ্বকাপের, ওটাকে আমি এক নম্বরে রাখি।