ভ্যান গখের আলুখোর—দ্য পটেটো ইটার্স
ভ্যান গখ 'দ্য পটেটো ইটার্স' এঁকেছেন ১৮৮৫-এর এপ্রিল ও মে মাসে। ক্যানভাসে তেলরঙের ছবি, দৈর্ঘ্য ১১৪ সেন্টিমিটার, উচ্চতা ৮২ সেন্টিমিটার। ছবিটি রয়েছে আমস্টারডামের ভ্যান গখ মিউজিয়ামে। শিল্পী এই ছবিতে গ্রামীণ জীবনের রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছেন। চাষিদের বিষণ্ন গ্রাম্য চেহারা, হাড় বেরিয়ে আসা চোয়াল, তাদের সততার অর্জন নিজেদের উৎপাদিত আলুর দিকে বাড়ানো হাত। শিল্পী মেটে রং ব্যবহার করে পাঁচটি মানবদেহ আঁকলেন, রংটা অনেকটাই ধূলিধুসর আলুর।
একালের সমালোচক ছবিটার অন্ধকারাচ্ছন্নতা পছন্দ করছেন না, এমনকি ফিগার আঁকতে শিল্পী কতটা ভুল করেছেন, তারও তালিকা করছেন। তবুও এটা ভ্যান গখের শ্রেষ্ঠ ছবির একটি। ছবি আঁকার দুবছর পর বোন ভিলেমিনাকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, এটিই তার আঁকা সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি। ১৮৮৫-তে আঁকা দ্য কটেজ ছবিঘরটি দুটো পরিবারের, এক পরিবার ডি গ্রুটসতের, তারাই পটেটো ইটার্সের সাবজেক্ট। খ্রিস্টীয় ধর্মচেতনার লাস্ট সাপারের সাথে এর অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তোমার ভেতরের কোনো স্বর যদি বলে 'তুমি আঁকতে পারবে না', তখন যেভাবেই হোক তোমাকে আঁকতে হবে, তখন সেই স্বর নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।
ভিনসেন্ট ভ্যান গখ আরও শোনালেন, 'যখন আমি ছবি আঁকছি, কেবল তখনই অনুভব করি যে আমি বেঁচে আছি।' তীব্র শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে এমনকি পাগলাগারদে থাকা অবস্থায়ও যে ছবি তিনি এঁকেছেন, তা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত ও সবচেয়ে মূল্যবান ছবিগুলোর অন্যতম।
'আমি আমার ছবিগুলোকে স্বপ্নে দেখি এবং আমার স্বপ্নগুলোকে আঁকি।'
ভিনসেন্ট ভ্যান গখের আহ্বান—'যত বেশি সম্ভব সুন্দর খুঁজে বের করো, অধিকাংশ মানুষ কেবল সামান্য কিছু সুন্দরের হদিস পায়।'
পল সেজান এই ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীকে বলেছেন, 'কসম, তুমি ছবি আঁকো পাগলের মতো।' ভিনসেন্ট ভ্যান গখের দারিদ্র্যের একটি চিত্র তুলে ধরাই যথেষ্ট হবে—হাতে পয়সা না থাকায় তিনি ছবির জন্য সিটিং দিতে কোনো নারী মডেলকে ডাকতে পারেননি।
কথা ছিল চার্চের ধর্মযাজক হবেন
বাবা রেভারেন্ড থিওডোর ভ্যান গখ ডাচ রিফর্মড চার্চের গণ্যমান্য পুরোহিত ছিলেন। বাবার চেয়ে ছেলেরই বেশি চাওয়া ছিল তিনি ধর্মযাজক হবেন। তবে সাময়িকভাবে যাজকের সহকারী হয়ে কিছুদিন কাজও করেছেন। ধর্মতত্ত্ব পড়াশোনা করার জন্য দুবার পরীক্ষায় বসেছেন, কিন্তু সফলকাম হননি, হয়েছেন চিত্রকলার যাজক।
ভ্যান গখের চেয়ে তিন বছরের বড় মাদকাসক্ত যৌনকর্মী সিন, আসল নাম ক্ল্যাসিনা মারিয়া এবং তার পাঁচ বছর বয়সী কন্যার সাথে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ১৮৮২-এর জানুয়ারির শেষ দিকে ভ্যান গখ আর সিনের প্রথম দেখা, সিন তখন গর্ভবতী, তারা একসাথে থাকতে শুরু করেন।
২ জুলাই তাঁর পুত্রসন্তান ভিলেমের জন্ম হয়। ভ্যান গখের বাবা-মার প্রচণ্ড চাপ তিনি যেন অবিলম্বে সিনকে ত্যাগ করেন। তিনি গনোরিয়া আক্রান্ত হয়ে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে কাটান। ১৮৮৩-তে বিভিন্ন কারণে তিনি হঠাৎ গড়ে ওঠা পরিবার ত্যাগ করেন। সিন যৌনকর্মী হিসেবে নিজ পেশায় ফিরে যান। ভিলেমের বয়স যখন চৌদ্দ, তার পিতৃত্বের বৈধতার কথা ওঠে। সিন পরে বলেন: 'আমি জানি, এই ছেলের বাবা কে। তিনি একজন চিত্রশিল্পী, কুড়ি বছর আগে আমি তার সাথে হেগে বাস করতাম। তার নাম ভ্যান গখ।'
কিন্তু সময়ের হিসাবে তা মেলে না। ভিলেম বিশ্বাস করতেন, ভ্যান গখই তার বাবা। সিন ১৯০৪ সালে শেল্ড নদীতে আত্মহনন করেন।
একজীবনে কত কাজ
৩৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে, দারিদ্র্যজর্জর অবস্থায় মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘ সময় থাকার পরও ৯০০ পেইন্টিং এবং ১১০০ ড্রইং রেখে গেছেন। চিঠি লিখেছেন ৮০০। জীবদ্দশায় তাঁর একটি মাত্র ছবি দ্য রেড ভিনিয়ার্ড বিক্রি হয়েছে। বন্ধু গগ্যাঁকে আক্রমণ করতে গিয়ে নিজেরই কান কেটে ফেলেছেন।
তাঁর আঁকা একজন চিকিৎসক ডাক্তার গ্যাচেটের পোর্ট্রেট বিক্রি হয়েছে ৮২.৫ মিলিয়ন ডলার। এর চেয়ে আরও বেশি মূল্যবান দ্য স্টারি নাইটস তিনি এঁকেছেন পাগলাগারদে থাকা অবস্থায়।
আলু নিয়ে আঁকা আরও কিছু ছবি
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী আর্নেস্ট হিগিন রিগ (১৮৬৮-১৯৪৭) এঁকেছেন দ্য পটেটো পিকার্স
আর্নেস্ট রিগের দ্য পটেটো পিকার্স
ডেনিশ চিত্রশিল্পী ডেভিড মনিস (১৮১২—১৮৯৪) এঁকেছেন হট পটেটো
টাইমলাইন ভ্যান গখ
১৮৫৩: জন্ম ৩০ মার্চ নেদারল্যান্ডসের জুনডার্ট গ্রামে (জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)
১৮৬০: জুনডার্ট গ্রামের স্কুলে ভর্তি
১৮৬৬: মিডল স্কুলে ভর্তি
১৮৬৮: স্কুল পরিত্যাগ
১৮৬৯: চাচা ভিনসেন্টের সাথে আর্ট ডিলার হিসেবে কাজ শুরু
১৮৭৩: লন্ডনে বদলি, ৮৭ হ্যাশফোর্ড রোড, ব্রিক্সটনে অবস্থান, ল্যান্ডলেডির কন্যার প্রতি আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত
১৮৭৬: প্যারিসে শিল্পকে পণ্য হতে দেখে ক্ষুব্ধ, চাকরিচ্যুত
১৮৭৭: স্কুলে শিক্ষকতা, ধর্মযাচকের সহকারীর দায়িত্ব গ্রহণ, বইয়ের দোকানে সেলসম্যান
১৮৮৮: ধর্মতত্ত্ব পড়তে আগ্রহী হলেন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য
১৮৯০: ব্রাসেলসে ডাচ শিল্পী ভিলেম রোলফের কাছে শিক্ষানবিশ
১৮৮২: অ্যালকোহল আসক্ত দেহজীবী ক্লসিনা মারিয়ার সাথে সম্পর্র্ক, গনেরিয়ায় আক্রান্ত
১৮৮৫: দ্য পটেটো ইটার্স অঙ্কন
১৮৮৮: ১ মে থেকে ইয়েলো হাউসে (বাড়ির দেয়াল হলদে) বসতি। ২৩ অক্টোবর পল গগ্যাঁর তাঁর সাথে দেখা করতে প্যারিস আগমন
১৮৮৯: সেইন্ট রেমি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি
১৮৯০: প্রদর্শনীতে একটি ছবি দ্য রেড ভিনিয়ার্ড বিক্রি
২৭ জুলাই বিষণ্ন মনে শস্যখেতে এসে নিজেকে গুলিবর্ষণ
২৯ জুলাই মৃত্যুবরণ
কয়েকটি সেরা ছবি: দ্য ব্রিজ অ্যাট ল্যাঙলয়, দ্য পটোটা ইটার্স, সানফ্লাওয়ার্স, দ্য স্টারি নাইট, আইরিসেস, পোট্রেট অব ডক্টর গ্যাচেট, স্কাল উইথ আ বার্নিং সিগারেট, স্টিল লাইফ: ভাস উইথ টুয়েলভ সানফ্লাউয়ার্স, হুইটফিল্ডস উইথ ক্রৌস, থ্যাচেড কটেজ বাই আ হিল।