ওজন কমাতে চাই, কিন্তু পারছি না; কেন?
আমি বরাবরই স্থূলকায়। যদিও আমি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটি যথেষ্ট মেনে চলার চেষ্টা করি। কর্পোরেট পাড়ায় কর্মস্থল, ব্যস্ততা সকাল-সাঁঝ, তবু কাজের ফাঁকের স্বল্প অবসরগুলোয় জিম করা বা হালকা শরীরচর্চা করার চেষ্টা করি।
ভালোই চলছিল, কিন্তু আমার মুটিয়ে যাওয়া কমছেই না। বরং দিন দিন বিষয়টা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেল। নিজের ডিপ্রেশনও বাড়তে লাগল।
শেষ পর্যন্ত একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। চিকিৎসক শোনালেন ভিন্ন গল্প।
গল্পের শুরুটা ছিল এমন- বৃহৎ অবয়বে সুস্বাস্থ্য, অন্নে পড়েছে বাধা, ব্যয়াম+ ডায়েটিং করে চলেছি……… শরীর কমেনি আধা।
এক থালা ভাত, মাংসের ঝোল,আরও কত কি? এগুলোর নাম শুনলেই যেন জিহ্বায় জল এসে যায়। একজন ভোজন বিলাসী দৈনিক রসনা বিলাসে আর কি চায়! আত্মা পুরিয়ে প্রতিবেলায় এসব খাচ্ছেন, তাহলে ওজন বাড়বে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু এক মুঠো ভাত, সামান্য সবজি, পরিমিত আহার, নিয়মিত শরীর চর্চা, একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন; তবু শরীরের ওজন কিছুতেই কমছে না ।
এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আসলে ব্যাখ্যাটা এমন কঠিন কিছু নয়। যে কেউ খুব সহজেই তার অতিরিক্ত মেদের কারণ খুঁজে পেতে পারবে।
কারণগুলোকে আমরা নিচের আলোচনা থেকে বের করতে চেষ্টা করব:
১) নিদ্রাহীনতা ওজন বাড়াতে পারে: আমরা যখন বিশ্রাম নেই, শরীর তার স্বাভাবিক ক্রিয়া তখনই সবচেয়ে ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারে।
কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে আমরা কাজ করা শুরু করব, আমাদের শরীরে বিভিন্ন চাপ পড়তে থাকবে এবং রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে মেদ জমতে থাকবে।
আমরা যখন ক্লান্ত, আমাদের শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেও তখন ক্লান্তি আসে। অনেকে মনে করেন একটু বাড়তি খাবার খুব সহজেই ঘুম বাড়িয়ে দিতে পারে। এই ধারণা থেকে অনেকে বেশি খেতে পারেন। কিন্তু আপনি নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করলে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে কখনোই গভীর ঘুম সম্ভব না।
বিশ্রাম স্বল্পতা সহজেই আপনার ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয়। এমনকি কার্যক্ষমতা কমিয়ে আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিরাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমান। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ১৫ মিনিট আগে বিছানায় যাবেন। এই সময় আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকুন। ফলে সহজেই আপনার ঘুমের সময়টাও বাড়বে এবং আপনি পাবেন একটি গভীর নিদ্রাময় রজনী।
২) অতিরিক্ত মানসিক চাপ বাড়ায় শারীরিক স্থূলতা: একটু বেশি কাজ, একটু বেশি বাঁচা, একটু বেশি অর্জন। আমাদের সমাজ প্রতিদিন আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে চলে। যা বাড়ায় আমাদের জীবনের মান, দ্রুত করে তোলে গতি; কিন্তু কমায় জীবনকাল।
প্রতিদিনের এই ছুটে চলা বাড়িয়ে দেয় মানসিক চাপ। এই চাপ আমাদের কর্মক্ষমতা সহজেই কমিয়ে দিতে পারে। ফলে জীবনের এই প্রাত্যাহিক চাহিদাগুলো শরীরে একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
ফলে শরীরে জমা থাকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের শারীরিক দহন ক্রিয়া কমাতে থাকে। পদার্থগুলো হলো: কর্টিসল,লেপ্টিন বা আরও কিছু হরমোন। এসব হরমোনের আধিক্য সহজেই উদরদেশে চর্বি বাড়িয়ে দেয়।
৩) কিছু কিছু ওষুধের প্রভাবে শরীরে চর্বি জমতে পারে: কিছু কিছু ওষুধ সেবনে বেড়ে যেতে পারে শারীরিক স্থূলতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্টেরয়েড >অ্যান্টিডিপ্রেশান্ট >অ্যান্টিসাইকোটিক >অ্যান্টিসিজার ড্রাগ (মৃগীজাতীয় রোগে ব্যবহৃত ঔষধ) >অ্যান্টিডায়াবেটিক ড্রাগ >উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শারীরিক স্থূলতা দেখা দিতে পারে।
৪) কিছু অসুখে বাড়তে পারে ওজন: কিছু হরমোনজনিত কারণে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। যেমন: থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা বা হাইপোথাইরয়েডিজম।
আপনি যদি দেখেন নিয়মিত আপনার খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে, ঠান্ডা সহ্য করতে পারছেন না, গলার স্বরে কিছু পরিবর্তন বা শরীর অস্বাভাবিক রকম ফুলে যাচ্ছে; তবে আপনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এসব লক্ষণ হাইপোথাইরয়েডিজমের।
আরেকটি বিষয় হলো কুসিংসিন্ড্রম, যা কর্টিসল নামক হরমোনের আধিক্যের কারণে হতে পারে। কুসিংসিন্ড্রম হলেও অনেক সময় ওজন বাড়তে পারে।
৫) নারীদের ক্ষেত্রে বয়স বৃদ্ধি বাড়াতে পারে ওজন: একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরে নারীদের ঋতু ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
সাধারণত ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব এসময় হয়ে থাকে। ইস্ট্রোজেন একটি স্ত্রী হরমোন। এই হরমোনই নারীদেহের গড়নের জন্য দায়ী। এর অভাব সহজেই নারীকে স্থূল করে তোলে।
ফলে তার তলপেট, ঊরু বা জঙ্ঘা দেশে চর্বি জমতে পারে। এছাড়া জন্ম নিয়ন্ত্রণ ট্যাবলেট শারীরিক কলেবর বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
- ডা. শেখ আরিফুর রহমান: চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা