গ্রাহকদের কাছে বিপুল পাওনা, সংকটে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো
পারস্পরিক আর্থিক সম্পর্কের জটিল এক জালে জড়িয়ে বকেয়া মূল্য পরিশোধ নিয়ে হিমশিম দশা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানাগুলোর।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ও সার কোম্পানিগুলোর কাছে ২৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা পাওনা আছে পেট্রোবাংলার। আবার দেশি ও বিদেশি গ্যাস সরবরাহকারীরা প্রতি মাসে পেট্রোবাংলার কাছে পাবে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে সময়মতো সরকারি ভর্তুকির অর্থ ছাড় না হওয়াকে পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া পরিশোধের অক্ষমতার জন্য দায়ী করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানাগুলো।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানায়, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকের কাছে পেট্রোবাংলার আওতাধীন ছয়টি গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানির পাওনা ছিল ২৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা।
এই বকেয়ার মধ্যে ৪৫ শতাংশই হচ্ছে – বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)-সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার। বাকি ৫৫ ভাগ বেসরকারি খাতের, বিশেষত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের।
একই দশা বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানির কাছে সরকারি ও বেসরকারি গ্রাহকদের বকেয়া বিল ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পৌঁছেছে ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়।
গ্যাস কেনা বাবদ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছে গত এক বছর ধরেই প্রতি মাস শেষে ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দেনা থাকছে পেট্রোবাংলার, এতে সংস্থাটির আর্থিক সমস্যা আরও বেড়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ সমস্যার কথা স্বীকার করে জানান যে, এসব পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চিঠিপত্র দেওয়া এবং আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা করাসহ সমন্বিত উপায়ে চেষ্টা চলছে।
সাম্প্রতিক এক বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-র কাছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)-র কাছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পাবে পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার আওতাধীন কোম্পানিগুলো থেকে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গ্যাস কেনে বিপিডিবি। সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে পেট্রোবাংলার ২৮৩ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করেছে বিপিডিবি।
বিসিআইসির অপরিশোধিত বিলের বিষয়ে– সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান সভায় জানান, বিল পরিশোধের অর্থ বরাদ্দের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়াও দেয়।
এছাড়া, বড় অংকের গ্যাস বিল জমে যাওয়ায়– দুটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও হিমশিম অবস্থা। গত বছরের মার্চের পর তারা কোনো বিল পরিশোধ করেনি।
জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, "বেসরকারি খাতের পাওনা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ এর পরিমাণ যেমন কম, তেমনি বিলিং টাইমের কারণে এক মাসের পাওনা সাধারণত বকেয়া থাকে।"
ডিসেম্বর শেষে গ্যাস বিতরণকারী ছয় কোম্পানির বকেয়া পাওনা দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা কমেছে বলেও জানান তিনি।
গ্যাস বিতরণকারী ৬ কোম্পানির বকেয়া পাওনা
জ্বালানি বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার আওতাধীন– তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বকেয়া পাওনা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি গ্রাহকদের থেকে ১২ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা পাবে।
একইভাবে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড পাবে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। কর্ণফুলী গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি পাবে ১ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ১ হাজার ১৬২ কোটি, বাখরাবাদ গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন লিমিটেড ২ হাজার ৮৯৯ কোটি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড পাবে ৮২২ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার আওতাধীন এই ৬ কোম্পানি সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি-পর্যায়ের গ্রাহককে গ্যাস সরবরাহ করে। কোম্পানিগুলো ৭১টি বিদ্যুৎ কোম্পানি, পাঁচটি সার কারখানা, দেশের সকল শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সিএনজি স্টেশন, চা বাগান, আবাসিক সংযোগ ও ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। যদিও সকল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানা একসাথে চালু থাকে না।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ জানুয়ারি এই ছয়টি কোম্পানি বিদ্যুৎ খাতে (গ্রিড পাওয়ার ও নন-গ্রিড পাওয়ার) ৮২৩ এমএমসিএফডি, সার কারখানায় ২১৩ এমএমসিএফডি এবং অন্যান্য খাতে ১ হাজার ৪৮৬ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করেছে।
বকেয়া পাওনা আদায়ের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: হারুনুর রশীদ মোল্লাহর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও– তিনি সাড়া দেননি।
একইভাবে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুখসানা নাজমা ইছহাক কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বিদ্যুৎখাতে বকেয়া
২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গ্রাহকদের থেকে বিপিডিবির পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। বকেয়া বিল বাবদ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) পাবে ৪ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
এছাড়া, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) পাবে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ৭২২ কোটি, ওয়েস্ট জোন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ৪২২ কোটি টাকা এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড ৬৭১ কোটি টাকা পাবে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে বিপিডিবি। এই ক্রয় বাবদ, ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপিডিবির কাছে তাঁদের পাওনা ২২ হাজার কোটি টাকা।
দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিপিডিবি প্রতি মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ ক্রয় করে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপিডিবি সাধারণত দুই মাস পর পর ১১ হাজার কোটি টাকা করে এই বিল পরিশোধ করতো। তবে গত দুই বছর ধরে বিল পরিশোধে বিলম্ব বেড়ে চার থেকে পাঁচ মাসে দাঁড়িয়েছে।
বিল পরিশোধের এই দেরীতে প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত। একারণে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল বা কয়লা আমদানির জন্য দরকারি তহবিলের সংকটে পড়েছেন বলে জানান এখাতের উদ্যোক্তারা।
এর আগে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)-র সভাপতি মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান বলেন, "আজ (২৪ জানুয়ারি), যেসব স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্যের বিপরীতে কার্যকরী মূলধন রয়েছে, ওইসব ব্যাংকে অর্থ মন্ত্রণালয় সমর্থিত বন্ড ইস্যু করা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।"
তিনি বলেন, 'বিপিডিবি যে পরিমাণ ভর্তুকি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পায়নি, ওই পরিমাণ বন্ড ছাড়া হবে। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে আইপিপিগুলোর পাওনা এভাবে বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করার কাজ শুরু হলো। '
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিনের বকেয়া পাওনা পেতে শুরু করায় আইপিপিগুলো সন্তুষ্ট।
ফয়সাল খান বলেন, আশা করি বিপিডিবি মাসিক বিল নিয়মিত করবে এবং চুক্তি অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ শুরু করবে, যাতে আইপিপিগুলো চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।