তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত, ৪ উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়ছে লাখো মানুষ। কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির গতি কমে আসছে। ধরলা, দুধকুমার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে নদী সংলগ্ন এলাকা এবং নিম্নাঞ্চল।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমার পানি কমলেও নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। ফলে জেলা শহরের আশপাশের এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনও পানিবন্ধী রয়েছে মানুষ। শহরের বাইরেও নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এ ছাড়া সড়কে পানি ওঠায় জেলা সদরের সঙ্গে চার উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোডের্র বন্যা নিয়ন্ত্রণের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ ঘণ্টায় ধরলা ব্রিজ পয়েন্টে পানি তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া নুনখাওয়া পয়েন্টে দুধকুমারের পানি তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী উপজেলার চিলমারী ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপূত্রের পানি চার সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ঘাট পয়েন্টে গত ১২ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি দুই সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলের কারণে কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরলা, দুধকুমার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদী সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটেছে। এতে পানিবন্দী হয়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ধরলা ও তিস্তার পানি কমে গেলেও দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
''উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট,নীলফামারী, বগুড়া ও দিনাজপুরে আগামী দুই সপ্তাহ বন্যার পানি বাড়তে পারে। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অন্তত পাঁচটি নদীর পানি পাশের জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, পদ্মা, আত্রাই ও হাওর এলাকার নদীগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে'', যোগ করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, আগামী এক সপ্তাহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১০২টি পয়েন্টের মধ্যে ৭৮টির পানি বাড়ছে। সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদ্মার পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
নীলফামারীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, সোমবার সকালে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় তা আবার দুই সেন্টিমিটার কমে আসে।
ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ মিটার। বর্তমানে পানির প্রবাহ চলছে ৫২ দশমিক ৮০ মিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট ২৪ ঘন্টা খুলে রাখা হয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম জানান, রংপুর অঞ্চলের বৃহৎ চারটি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত পাঁচটি জেলায় ১৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা ও ৭৪৫ টন জিআরের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারি হিসাব মতে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার ১০৩টি ইউনিয়নের প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে।
চার উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
হাওরে এসে সুরমার পানি চাপ তৈরি করায় পৌর শহরের হাজিপাড়া, নতুনপাড়া, পশ্চিম হাজিপাড়া, কালিপুর, শান্তিবাগসহ বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। অনেক মানুষের ঘরবাড়িতে নতুন করে পানি প্রবেশ করেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে এখনো জেলা শহরের সঙ্গে বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজারসহ চারটি উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন আছে। বিভিন্ন স্থানে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্ধী থাকার কথা জানালেও প্রায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্ধী রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৬১টি ইউনিয়নে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। জেলায় এ পর্যন্ত ১২৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে এক হাজার ১৯৪টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বন্যায় ৬৬ হাজার ৮৬৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ৪১০ টন চাল ও ২৯ লাখ টাকা ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে প্রশাসন। আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধকরণ পানির ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে ২৮ জুন রাত থেকে বৃষ্টিপাত কমায় উন্নতির আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, সোমবার সুরমা নদীর পানি সকাল ১২টায় বিপৎসীমার ৩২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতও কমেছে। গত ২৪ ঘন্টায় মাত্র ১৩ মি.মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, নদীর পানি এখন হাওর এলাকায় গিয়ে চাপ তৈরি করবে। এতে এসব এলাকায় কিছু পানি বাড়বে।
জেলা প্রশাসক জানালেন, পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। যার আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে তাদেরকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। জেলার সব উপজেলাতেই আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি আছে। তাছাড়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে প্রশাসন।
নেত্রকোনায় কমছে বন্যার পানি
নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
রোববার রাতের পর থেকে সোমবার দুপুর নাগাদ কলমাকান্দায় বৃষ্টিপাত হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। তবে কলমাকান্দা সদর, রংছাতি, বড়খাপন ও খারনৈ ইউনিয়নে প্লাবিত শতাধিক গ্রাম এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।
রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহেরা বেগম জানান, ওই ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ এখনও পানিবন্দী। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত। বড়–য়াকোনা বাজার, সন্ন্যাসী পাড়া ও মৌতলা গ্রামে মহাদেও নদীতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এছাড়া কলমাকান্দা-পাঁচগাও সড়কের নল্লাপাড়া এলাকার রসুর ব্রিজটির দু'পাশের অ্যাপ্রোচের মাটি ধসে যাওয়ায় ওই ইউনিয়নটি উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, কলমাকান্দা সদরে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের বিভিন্ন সরকারি অফিস এখনও পানিবন্দী। এছাড়া মন্তলা, চানপুর, পূর্ব বাজার, শিবমন্দির রোড, স্টেডিয়াম রোড, মুক্তিরনগর, নয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকার দুই শতাধিক বাসাবাড়ির ভিটামাটি এখনও পানির নিচে রয়েছে।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান জানান, কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং উদ্বাখালি নদীর পানি ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া দুর্গাপুর ও বিজয়পুর পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদী এবং জারিয়ায় কংস নদীর পানি বিপৎসীমার বেশ নিচে রয়েছে।
নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় ভাঙ্গ ঠেকাতে জরুরী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।