সমন্বয় ও মনিটরিংয়ের অভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না: বিশেষজ্ঞদের অভিমত
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা দমনে সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রমের সাথে অন্যান্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। ফলে হাতে নেওয়া কার্যক্রমের মনিটরিংয়ের অভাবে অনেক চেষ্টা করেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
তাদের পরামর্শ, নগরের প্রতিটি সংস্থার সাথে সমন্বয় এবং সম্পৃক্ত করে এডিস মশা নির্মূলে কাজ করতে হবে। সাথে সাথে ডেঙ্গু জন্য টার্গেট ফিক্সড করতে হবে এবং এর জন্য নিয়মিত সার্ভিলেন্স করতে হবে বলে মত দেন তারা।
গতকাল (সোমবার) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনে 'এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু মোকাবিলায় বছরব্যাপী উত্তর সিটির প্রস্তুতি এবং করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
বৈঠকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার বলেন, "যতদিন অন্যান্য মশার সঙ্গে এডিস মশাকে মেশানো হবে, ততদিন দেশ থেকে ডেঙ্গু যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন আলাদা ব্যবস্থাপনা। মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলতে হবে। একটি ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট, আরেকটি হচ্ছে কিউলেক্স ম্যানেজমেন্ট।"
কবিরুল বাসার আরও বলেন, "২০২৩ সালে সব থেকে বেশি ডেঙ্গুর প্রজনন ক্ষেত্র ছিল বহুতল ভবনের বেইজমেন্টে। ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয়েছিল বেজমেন্টে আর ২৩ শতাংশ ডেঙ্গুর প্রজনন হয় নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে।"
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, "এই মুহূর্তে ঢাকায় ৯৯ ভাগ কিউলেক্স মশা আছে, আর ১ ভাগ এডিস ও অন্যান্য মশা আছে। এই ১ ভাগ এডিস মশাই জনস্বাস্থ্যে সমস্যা তৈরি করে।"
কবিরুল বাশার মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়িত্বই সিটি কর্পোরেশনের। তারা যেমন মশা মারতে কাজ করবে তেমনি বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজও করবে। সাথে সাথে মশা দমনের বিভিন্ন কীটনাশক অবশ্যই জনগণের সাধ্যের মধ্যে হতে হবে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, "ঢাকা উত্তর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে কাজ করছে। এটার জন্য সাধুবাদ জানাই। আপনারাই (মেয়র আতিকুল ইসলাম) বারবার বলছেন সমন্বয় করার কথা। কিন্তু আপনাদেরই সমন্বয়ের অভাব থেকে গেছে। মশা বা ডেঙ্গু সমস্যা শুধু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট, রাজউক ও গণপূর্ত সবার আলাদা আলাদা ক্ষেত্র রয়েছে। তাই সবাইকে নিয়েই সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।"
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নাজির আহমেদ বলেন, "ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে পারেন। এতে যেমন শিক্ষার্থীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ শিখতে পারবে। তেমনি পরবর্তীতে তাদেরকেই সিটি কর্পোরেশনে কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। তাদেরকে নতুন করে প্রশিক্ষিত করার দরকার হবে না। হাতুড়ে লোকবল দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।"
তিনি আরও বলেন, "সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরিপ, ইন্টারভেনশন জরিপ দরকার। সিটি কর্পোরেশনের বাজেট পর্যাপ্ত রয়েছে কিন্তু কার্যক্রমের মডেলে ভুল। ঢাকা উত্তর একটি মডেল তৈরি করুক যা দেশব্যাপী ফলো করবে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ৬ টি চ্যালেঞ্জ ঢাকা উত্তরের
সভায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম চালানোর কথা জানিয়েছে। সাথে সাথে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ৬ চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরি বলেন, "অপরিকল্পিত নগরায়ণ; জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি; নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের জ্ঞানের অভাব এবং অসহযোগিতা; পরিত্যক্ত অপরিকল্পিত ছাদবাগান; বেজমেন্ট পার্কিংয়ে জমা হওয়া পানি এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সংখ্যার তথ্যে অপ্রতুলতা ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ।"
বছরব্যাপী ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, মশক নিধন কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন; তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য ৩ স্তর বিশিষ্ট কমিটি গঠন; এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে সপ্তাহব্যাপী একটি করে বিশেষ মশক নিধন অভিযান; ডেঙ্গু বিষয়ক প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ল্যাব স্থাপন ইত্যাদি।
ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, "আমরা এ মাসের শেষের দিকে জনসচেতনতার কাজ করবো। যেখানে দুর্গম ও সমস্যা প্রকট সেখানে আমরা বাফেল টার্বাইন মেশিন ব্যবহার করবো। আমরা হট স্পট নির্ণয় এবং মনিটরিং করবো। সাথে সাথে এটাও বলতে চাই, যার যার জায়গা তাদেরকেই পরিষ্কার করতে হবে।
মেয়র আরও বলেন, "আমরা ব্লেইম গেম নয়, আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে চাই। এডিসের বিরুদ্ধে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এক পা পেছাবে না।"