ট্রাম্প-ইউরোপ সম্পর্ক: ছিদ্র থেকে ফাটলে রূপ
৭০ বছরেরও বেশিকাল ধরে, ট্রান্সলান্টিক জোট ইউরোপিয়ান স্থিতির অটল ভিত্তি ও যুক্তরাষ্ট্র-চালিত পশ্চিমা শৃঙ্খলার মূল্যবোধের অনড় অবস্থা জারি রেখে এসেছে। ২০২০ সালে দেখা গেল, এই সম্পর্ক নিয়ে আটলান্টিকের দুই পারেরই নতুন করে ভাববার রয়েছে।
এ সপ্তাহের শুরুতে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার 'নিরাপদ রাষ্ট্রসমূহে'র তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নাম সংযুক্ত করতে অস্বীকার করেছে; তার মানে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার দিকে তাকিয়ে অশ্রুবিসর্জন করলেও, অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের মাটিতে আমেরিকান পর্যটকদের স্বাগত জানানো হবে না বলেই অনুমান করা যাচ্ছে। এদিকে বিতর্কিতভাবে, পারস্পরিক ব্যবস্থাপনার শর্তে ওই তালিকায় ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউরোপিয়ানদের একাধিকবার তীব্র সমালোচনাকারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সম্ভবত সান্ত্বনা দিতেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ জোরের সঙ্গে জানিয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং বৈশ্বিক মহামারিটির পরিস্থিতির ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন, আমেরিকানদের জন্য আরও সুস্বাদু বটিকা বানানোর ইচ্ছে ছিল ব্রাসেলসের; তাতে চিনির প্রলেপ জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন তারা! 'অতীতে তাকালে দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য তালিকায় চীনকে অন্তর্ভুক্ত না করাই ছিল আমাদের জন্য স্বাভাবিক রেওয়াজ,' সিদ্ধান্তটি নেওয়া সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিকভাবে এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জনৈক কূটনীতিক।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যদি সামনে তুলে না ধরেন, তাহলে ট্রান্সলান্টিক সম্পর্কগুলোর ফাটলের সাক্ষ্য হিসেবে এই ঘটনা একটি দাগ হয়ে থাকবে বলে মনে হতে পারে। ইউরোপিয়ান সম্পর্কের ব্যাপারে আজকাল ওয়াশিংটনের যে খুব একটা আগ্রহ নেই, সেটি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। আর, আমেরিকার কাছ থেকে আরও ব্যাপক পরিসরের কূটনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ফিরে পাওয়ার পথ সক্রিয়ভাবে খুঁজছে ইউরোপিয়ান জাতিগুলো, এটাও খুবই পরিচিত ঘটনা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে সত্য।
একদিক থেকে ব্রাসেলস ভাবে, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিজের দূরত্ব তৈরি করতে, এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরির মাধ্যমে দুনিয়ার সুপারপাওয়ারগুলোর একটির ওপর নির্ভশীলতা কমাতে পারবে ইউরোপ।
বিগত কয়েক বছরে, ট্রাম্প যা কিছু ভেঙে দিয়েছেন, সেইসব বড় বড় আন্তর্জাতিক বিষয়আশয়ে বন্দুক তাক করেছে ব্রাসেলস। প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকোর্ড, দ্য ইরান নিউক্লিয়ার ডিল, ফাইভ-জি'র কথা মাথায় এনে খেয়াল করলে দেখবেন, কীভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার পুরাতন মিত্র চীনের পক্ষে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গভীর ও সুপ্রতিষ্ঠিত বন্ধনের নিরিখে নিশ্চিতভাবেই এটি হয়তো পরিস্থিতিটির একটি সঙ্কীর্ণ পাঠ; তবে এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের প্রতি যেকোনো বন্ধুত্ব অনুভব করাটা সেই (যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ) সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভীষণ সত্যিকারের আঘাত হিসেবে গণ্য হবে।
'বৈশ্বিক মহামারির সময়কাল ও হোয়াইট হাউসের অবস্থানের মধ্যকার পরিস্থিতি চীন যেভাবে সামলিয়েছে, দেশটির সেই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমার ধারণা, তাদেরকে আমরা আরেকটি দুনিয়ায় সরিয়ে রাখতে পারব', বলেছেন সেই কূটনীতিক। আর আরেক দুনিয়া বলতে তিনি নিশ্চয় সেই দুনিয়া বোঝাননি, যেখানে ট্রাম্পের রাজত্ব।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিতে কাজ করেন, ব্রাসেলসের এমন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ইউরোপের এই সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রে যখন বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময়েই শুরু হয়েছে।
'মধ্যপ্রাচ্য যেহেতু (যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তুলনামূলকভাবে) ইউরোপিয়ান ভূরাজনৈতিক সমস্যা, তাই এ (মধ্যপ্রাচ্য) সম্পর্কে আগের প্রেসিডেন্টদের মতো অতটা আগ্রহ ছিল না ওবামার। আর এ কারণে ইউরোপের বদলে বরং চীন ও এশিয়ার প্রতি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তিনি,' বলেছেন সেই কর্মকর্তা।
অবশ্য, ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর দীর্ঘকাল যারা নজর রাখছেন, তাদের মতে, চার বছর আগেই এই সম্পর্ক শুকিয়ে গেছে; আসন্ন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পরাজিত করেন, তাহলে এ সম্পর্কের হাল আরও খারাপ হবে। 'ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বিশেষ করে জার্মানিকে নিজেদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করেন ট্রাম্প; তাই তিনি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে এ নিয়ে উত্তেজনা আরও বাড়বে,' বলেছেন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির ভেলিনা চাকারোভা।
তার ভাষ্য, 'নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ময়দানে আরও শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে' পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন; অন্যদিকে, 'ইউরোপিয়ান ন্যাটো সদস্যদের প্রতি আক্রমণ এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিস্তৃতির মাধ্যমে এ ধরনের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার' চেষ্টা চালাচ্ছেন ট্রাম্প।
ব্রাসেলসের সেই কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ইরানের মতো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে 'জোটবদ্ধতা ভেঙে' দিয়ে ট্রাম্প, 'ইউরোপিয়ান নিরাপত্তার গুরুত্ব কমিয়ে' দেওয়ার মাধ্যমে, ইউরোপিয়ানদের জন্য আমেরিকার কাছ থেকে এক পা দূরে সরে যাওয়া এবং 'বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজেদের খেয়াল নিজেরাই রাখার' বোঝাপড়াটি ত্বরান্বিত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এই শত্রুতাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করার পথে বাধা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওই কূটনীতিক। 'সমস্যা হলো, ওয়াশিংটনের যেসব কর্মকর্তা ইউরোপের সঙ্গে কাজ করতে চান, চুক্তি অনুসারে, গুরত্বের সঙ্গে এমন কাজে নিজেদের জড়ানোর নির্দেশ তারা সরকারের কাছ থেকে পান না। তারা এক ধরনের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন; তাই ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে, আমরা সত্যিকারের ঝামেলায় পড়ে যাব।'
চাকারোভাও মনে করেন, ঠিক এ কারণেই 'ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলো ও সদস্য রাষ্ট্রের নেতারা আশা করছেন, নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেন পাস করবেন।...তিনি জোটবদ্ধতার পক্ষের লোক, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যকার সম্পর্ক তিনি জোরাল করে তুলবেন বলেই আশা করা যায়।'
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আটলান্টিকের উভয় পারের বেশ কয়েকজন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তা ও কূটনীতিকের দ্বারস্থ হয়েছিল সিএনএন। তাদের অধিকাংশই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি; তবে কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, এমনটাই ধারণা তাদেরও। ইউরোপিয়ান এক কূটনীতিক বলেছেন, 'ড্যান্স ফ্লোরে যিনিই আসুন, তার সঙ্গেই নাচব আমরা; তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক যে এখন ভালো যাচ্ছে না, এটা বোঝার জন্য জিনিয়াস হওয়ার দরকার পড়ে না।'
যাহোক, যুক্ররাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভূমিকা যেখানে মজ্জাগতভাবে আরও বেশি আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠেছে, যেখানে দেশটির সঙ্গে আন্তরিকতার নামমাত্র আবরণ রেখে, ইউরোপ আসলে বিশ্ব পর্যায়ে নিজের নতুন ভূমিকার সন্ধান চালাচ্ছে; আর সেটি শুধু তাদের জন্যই ভালো খবর বয়ে আনতে পারে, যাদের বিরুদ্ধে কিছুকাল আগেও এই পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঐতিহাসিক জোট লড়াই করেছিল।
- লেখক: সিনিয়র প্রডিউসার, সিএনএন
সিএনএন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: রুদ্র আরিফ