ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং হৃদ্রোগে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে পারে: গবেষণা
দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মাঝেই সব খাবার গ্রহণের ধারণাটি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নামে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে ডায়েটের এই কৌশলটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সাধারণত এই পদ্ধতিতে দৈনিক মাত্র আট ঘণ্টা বা তার কম সময়ের মাঝেই খাবার খাওয়ার প্রতি জোর দেওয়া হয়। ফলে দিনের বাকি ১৬ ঘণ্টা ঐ ব্যক্তি না খেয়ে বা উপবাস করে থাকেন।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতিটি সহজ অর্থে 'সময় বেধে খাদ্য গ্রহণ' নামেও পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, এই খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা ব্যক্তিদের হৃদ্রোগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
গবেষণাটির ফলাফল গত সোমবার শিকাগোতে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের একটি মিটিংয়ে তুলে ধরা হয়েছে। মূলত ২০০৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনিদের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মেনে চলা ব্যক্তিদের হৃদ্রোগে মারা যাওয়ার ঝুঁকি দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময়ব্যাপী খাবার গ্রহণের ব্যক্তিদের তুলনায় প্রায় ৯১ শতাংশ বেশি।
গবেষকেরা দেখেন যে, এই অতিরিক্ত ঝুঁকি এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা ইতোমধ্যেই একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করেন তাদের হৃদ্রোগ বা স্ট্রোকে মৃত্যুঝুঁকি ৬৬ শতাংশ বেশি। একইভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও একই খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
এই বিষয়ে গবেষণাটির মূল লেখক ও সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের ভিক্টর ওয়েনজে ঝং বলেন, "গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মেনে চলেন, বিশেষ করে এদের মধ্যে যাদের হৃদ্রোগ বা ক্যান্সার রয়েছে, তাদের বিষয়টি নিয়ে 'অত্যন্ত সতর্ক হওয়া উচিত'।"
ঝং আরও বলেন, "এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন কত সময় ধরে খাবার খাচ্ছেন সেটির থেকে বরং মানুষ কী খাচ্ছেন সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
তবে গবেষণায় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কেন ঝুঁকিপূর্ণ সেটি কারণ নির্দিষ্ট করে তুলে ধরা হয়নি। এক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা যায়, যারা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করেন তাদের পেশির ওজন অন্যদের তুলনায় কম ছিল। জেএএমএ ইন্টারনাল মেডিসিনের এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও অনুরূপ তথ্য উঠে এসেছে।
বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পেশির সুস্থতা ধরে রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যক্তিকে যেকোনো ধরনের অক্ষমতা থেকে রক্ষা করে এবং বিপাকীয় ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ঝং বলেন, গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী, পেশির ওজন কম থাকা উচ্চ মৃত্যুর হারের সাথে যুক্ত। যার মধ্যে হৃদ্রোগে মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকির ব্যাপারটিও সম্পর্কিত।
ঝং জোর দিয়ে জানান, ফলাফলটি থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। কেননা এতে 'কারণের প্রেক্ষিতে প্রভাব' নির্দিষ্ট করে দেখানো সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে গবেষণায় স্যাম্পল হিসেবে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অন্যান্য অজানা অভ্যাস কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকিও ফ্যাক্টর হিসেবে থাকতে পারে যা তাদের হৃদ্রোগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধির কারণ।"
এছাড়াও গবেষণায় যে সমস্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে সেগুলো পুরোটাই স্যাম্পল হিসেবে নেওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। এক্ষেত্রে নিজেদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে তারা কতটুকু নির্ভুল তথ্য দিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংকে বহু তারকা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচকভাবে প্রচার করেছেন। একইসাথে দেহের ওজন কমাতে ও সর্বোপরি স্বাস্থ্যগত উপকারিতায় এর প্রভাব রয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
অনেকেই আবার ডায়েটের ক্ষেত্রে ৫:২ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এতে সপ্তাহে পাঁচদিন নিয়মিত খেয়ে বাকি দুইদিন উপবাস করা হয়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নিয়ে প্রথম দিকের কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এটি স্থূলতা ও বিপাকীয় সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে। এই গবেষণাগুলি অবশ্য বেশ ছোট পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে করা হয়েছিল।
এক্ষেত্রে দেখা যায়, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং মানুষের ওজন হ্রাস করতে এবং রক্তচাপ, রক্তে শর্করা এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করতে সহায়তা করে। যদিও এই গবেষণাগুলি মূলত স্বল্পমেয়াদি ছিল, সাধারণত এক থেকে তিন মাসব্যাপী।
২০২২ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কম-ক্যালোরিযুক্ত ডায়েট অনুসরণ করার জন্য সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত সময়ের মাঝেই সকল খাদ্য গ্রহণের চার্ট ফলো করানো হয়। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যারা সারাদিনব্যাপী একই পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়েছেন তাদের সাথে ঐ ডায়েট মেনে চলা ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য কোনো তফাত নেই।
অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে তাদের ওজন কমেনি। একইসাথে উভয় পক্ষেরই রক্তচাপ, রক্তে শর্করা, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য বিপাকীয় বিষয়াদির উপর একইরকম প্রভাব ছিল। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে শুধু কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলেই স্থূলতার ভালো কোনো সমাধান পাওয়া যেতে পারে বলে গবেষণায় দাবি করা হয়।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান