‘দেশের প্রথম প্রতিনিধি হতে পারা বাড়তি স্পেশাল’
এসএসসি পাস করার পরই ডাক মিলে যায় বাংলাদেশ দলে, খেলেন বিশ্বকাপ বাছাইয়ের টুর্নামেন্ট আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাতীয় দলে অভিষেকের পর অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত। নবম শ্রেণি থেকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শুরু, খেলেন ১৭-১৮ বছর। তবে পিঠের ইনজুরির সঙ্গে পেরে না ওঠায় স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা হয়নি তার। সাবেক বাঁহাতি এই স্পিনার খেলতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার স্বপ্ন পূরণ না হলেও স্বপ্ন দেখা থামাননি সৈকত। বাংলাদেশ একদিন টেস্ট মর্যাদা পাবে, টেস্ট ও বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করা যাবে; এই স্বপ্নে নাম লেখান আম্পায়ারিংয়ে। বেশ কয়েক বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করে ২০০৬ সালে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলের অংশ হন তিনি। আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে সৈকতের অভিষেক হয় ২০১০ সালে, মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
এখনও পর্যন্ত ১০ টেস্ট, ৬৩ ওয়ানডে ও ৪৫ টি-টোয়েন্টিতে আম্পায়ারিং করেছেন তিনি। মেয়েদের ক্রিকেটে আম্পায়ারিং দিয়ে বিশ্বকাপে অভিষেক সৈকতের। দেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে গত বছর অনুষ্ঠিত ছেলেদের বিশ্বকাপে পাঁচটি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন। এবার প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তার জায়গা হলো আইসিসির এলিট প্যানেলে। দীর্ঘ পথচলার পর দারুণ এই অর্জনে উচ্ছ্বসিত সৈকত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের খেলোয়াড়ী জীবন, আম্পারিংয়ের শুরু, লেখাপড়া, বাংলাদেশে আম্পায়ারিং করার চ্যালেঞ্জসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
আইসিসির এলিট প্যানেলে যুক্ত হওয়ার অনুভূতি
আইসিসি এলিট প্যানেলে জায়গা পাওয়া বড় সম্মানের। এই প্যানেলে দেশের প্রথম প্রতিনিধি হতে পারা বাড়তি স্পেশাল এবং আমার ওপর যে আস্থা রাখা হয়েছে, তা ন্যায্য প্রমাণ করতে মুখিয়ে আছি আমি। বছরের পর বছর ধরে অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে এবং আরও চ্যালেঞ্জিং অভিযানের জন্য আমি প্রস্তুত।
আম্পায়ারিংয়ের শুরু
আম্পায়ারিংয়ের শুরুটা হয় যখন আমরা ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপের জন্য কোয়ালিফাই করি। আমি ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফির দলে ছিলাম, সেবার আমরা কোয়ালিফাই করতে পারিনি। তখন থেকে আমার একটা ইনজুরি ছিল। ১৯৯৭ সালে আমরা যখন কোয়ালিফাই করলাম, আমি দলে না থাকায় আমার একটা দুঃখের কারণ ছিল। যেহেতু বিশ্বকাপ খেলতে পারতাম, কিন্তু খেলা হবে না। তখন চিন্তা করলাম যদি ক্রিকেট না খেলতে পারি তাহলে কী করা যায়। চিন্তা করলাম কোচিং করাব, কিন্তু ওটা একটা শারীরিক চাকরি ছিল। চিন্তা করলাম হয়তো বাংলাদেশ কোনো একদিন টেস্ট মর্যাদা পাবে, আমরা হয়তো টেস্ট আম্পায়ার হতে পারব বা বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করতে পারব। ওই চিন্তা থেকেই আম্পায়ারিংয়ে আসা।
প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ারিংয়ের স্মৃতি
পুরোপুরি মনে আছে। সেটা খুব সম্ভবত ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, সম্ভবত ৮ জানুয়ারি মিরপুরে। মিরপুরে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় সিরিজ ছিল, ওখানে আমার অভিষেক হয়। আমার খুব পছন্দের আম্পায়ার ছিলেন সাইমন টফেল, তখন আইসিসি অব দ্য ইয়ার হন। প্রথম দুইটা ম্যাচ আমি টফেলের সঙ্গে করি, রোমাঞ্চিত ছিলাম। যখন আমি দাঁড়ালাম আমার প্রথম ম্যাচে, দেখলাম বোলার অনেক জোরে বোলিং করছে। মনে হচ্ছিল ঘরোয়াতে অমন বল আমি মোকাবেলা করিনি। মানিয়ে নেওয়া আমার জন্য একটু কঠিন ছিল আর কি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচে আম্পায়ারিং
হ্যাঁ, ওটাও মনে আছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বরে যে মাঠটা আছে, ওখানে একটা তৃতীয় শ্রেণির ম্যাচে আম্পায়ারিং করি। তখন তো আসলে অতো নিয়ম-কানুন জেনে আসি নাই শুরুর দিকে। আমি জানতাম না কোন জুতা পরতে হয়, আমি ফরমাল জুতা পরে গেলাম। আমাদের একজন স্কোরার বললেন, এই জুতো পরে তো আম্পায়ারিং করে না। তারপর একটা বল যখন ওয়াইড হলো, বাই হলো; আমি ওয়াইড ও বাইয়ের সিগন্যাল দিলাম। আসলে ওয়াইড হলে তো ওয়াইড, বাই সিগন্যাল দেওয়ার দরকার হয় না। ওখান থেকে শুরু। তারপর আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হলাম, আন্তর্জাতিক ম্যাচ করলাম।
খেলোয়াড়ী ক্যারিয়ার
আমি ১৯৮৯-১৯৯০ এর দিকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে আসি, যখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। প্রিমিয়ার লিগে প্রথম ম্যাচ সূর্য তরুণের হয়ে খেলি আমি। এসএসসি পাস করার পর ১৯৯২ সালে আমি বাংলাদেশ দলে খেলি। ৩০ বছরের বেশি হয়ে গেছে, আমি আসলে খুব ছোট ছিলাম। স্কুল পাশ করে আমি সাফ ক্রিকেটে খেলি, ১৯৯৪ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে খেলি। আমি জাতীয় দলে খেলার পরে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে খেলি, আমি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলাম। নিয়মিত হতে পারিনি (জাতীয় দলে), কিন্তু আমি ১৭-১৮ বছর প্রিমিয়ার লিগে খেলেছি। একটা প্রথম শ্রেণির সিরিজ খেলি। তারপর ব্যাক পেইনের কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি হয়তো চাকরি করব, পড়ালেখা করব, পরে আম্পায়ারিংয়ে আসি।
শিক্ষা জীবন
আম্পায়ারিংয়ে পড়াশোনা দরকার হয়, যদি পড়াশোনা থাকে তাহলে খুবই ভালো হয়। যেটা আমাকে সাহায্য করেছে। যদি ছোটবেলা থেকে বলি স্কুল ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, তারপর আমি রাজশাহী কলেজে চলে যাই। এরপর আমি ঢাকা চলে আসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অনার্স, মাস্টার্স করি। তারপর আমি এআইইউবি থেকে ম্যানেজমেন্ট এন্ড হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে এমবিএ করি।
বাংলাদেশের হয়ে আম্পায়ারিং করতে নামার অনুভূতি
এখানে আসলে আম্পায়ারিং করাটা খুব চাপের হয়ে যায়। আমরা তো ক্রিকেট পাগল জাতি, এখানে সবাই চায় দেশ জিতুক, দল জিতুক, আমরাও চাই। কিন্তু আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে, আমরা যখন মাঠে যাই, আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। আমরা পক্ষপাতী হতে পারব না। দিনেশেষে বাংলাদেশ জিতলে আমাদেরও খুশি লাগে। আমি নিজেও বাংলাদেশি, বাংলাদেশের পক্ষে খেলেছি। ম্যাচ জিতলে আমাদেরও খুশি লাগে। আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল হয়, এটা জীবনের অংশ, আম্পায়ারিংয়ের অংশ। এটা মানুষের মেনে নিতে হবে। আম্পায়রিং করাটা যে কঠিন কাজ, এই ধারণা মানুষের মধ্যে আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। এটা মানতে হবে আম্পায়ার মানুষ, আম্পায়ারও ভুল করেন, এটাই স্বাভাবিক।
বিশ্বকাপে আম্পায়ারিংয়ের অভিজ্ঞতা
আমি বিশ্বকাপ করেছি, অস্ট্রেলিয়াতেও টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছি। কিন্তু বিদেশের মাটিতে আমি খুব একটা চাপ অনুভব করি না, যেটা আমি দেশের মাটিতে করি। মানুষের হয়তো প্রত্যাশা থাকে, কিন্তু মাঠে তো আম্পায়ার হিসেবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। কখনও কখনও হয়তো বিচারে ভুল হয়। আমরা ক্রিকেট পাগল জাতি, আমরাও চাই দলটা জিতুক, আমাদের সিদ্ধান্তের কারণে কখনও কখনও ফল এদিক-সেদিক হতে পারে, এটা খেলার অংশ, কেউ কখনও ইচ্ছা করে ভুল করেন না। আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া হয়। বিদেশের চেয়ে দেশে ম্যাচ করা অনেক কঠিন।
দেশের নতুন আম্পায়ারদের জন্য পরামর্শ
আম্পায়ারিং দেখতে অনেক সহজ কাজ মনে হয়। কিন্তু এটাে তেমন নয়, এটা খুবই কঠিন কাজ। আমি ক্রিকেট খেলে এসেছি, অনেক কিছু করেছি, কিন্তু আমার মনে হয় আম্পায়ারিংয়ের চেয়ে কঠিন কাজ এখন পর্যন্ত আমি করিনি। আম্পায়ারিংয়ে উত্থান-পতন থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরতে হবে, এমন দিন আপনার জীবনে আসবে না, বলা যাবে না এমন, এমন হবে। আমাদের দেশে খুবই অযাচিতভাবে সমালোচিত হন আম্পায়াররা। তাই আমি বলবো কখনও আত্মবিশ্বাস না হারাতে, ওই পর্যায়টা আমি পার করে এসেছি। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে অনেক আম্পায়ারিংয়ে আসেন বিখ্যাত হতে, ভাইরাল হতে ডেয, সবাই তাকে পছন্দ করবে। আম্পায়ারিংয়ের কাজটা একজন ফাইন্যান্স অফিসার বা একজন বিচারকের মতো। আপনি জনপ্রিয় চরিত্র হতে পারবেন না। সবার পছন্দের হওয়ার চেয়ে সবার কাছে সম্মানের পাত্র হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সব সময় লো প্রোফাইল মেইন্টেইন করতে বলা হয়, যেটা আমি সব সময় করে এসেছি। ভালো দিন, খারাপ দিন আসবেই। এটা যদি সবাই মানিয়ে নিতে পারে আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লক্ষ্যটা স্থির রাখতে পারে, সফল হবে।
ভারতে অনুষ্ঠিত ২০২৩ বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করার অভিজ্ঞতা
আমি যতোগুলো ম্যাচ করেছি, সবগুলোই ইন্টারেস্টিং ছিল। দ্রুততম সেঞ্চুরি হয়েছে, সাতদিন পরই দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙেছে ম্যাক্সওয়েল, ২০০ করেছে। আফগানিস্তান ইংল্যান্ডকে হারালো। নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ খুব জমেছে। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ ছিল আফগানিস্তান-নেদারল্যান্ডস। আমি হয়তো একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলাম, অবস্থান শক্ত করতে যেটা দরকার ছিল। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমি বিশ্বকাপে গিয়ে ভরকে যাইনি। আমার মনে হয় ওটারই একটা পুরস্কার আজ যে অর্জনটা এলো।