‘আমাদের কাছ থেকে আরও কর নিন’ কোভিড সঙ্কট উত্তরণে কর বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিলেন শীর্ষ ধনীরা
'সুপার রিচ'খ্যাত পৃথিবীর শীর্ষ ৮৩ ধনী নিজ দেশের সরকারের প্রতি তাদের ওপর আরোপিত করের পরিধি স্থায়ীভাবে বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
কোভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং শিক্ষা খাতের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় অর্থ চাহিদা মেটাতে এ আহ্বান জানান তারা। একইসঙ্গে, তারা অন্যান্য শীর্ষ ধনীদের প্রতিও এই প্রচেষ্টায় শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে অন্যতম; বিখ্যাত বেন অ্যান্ড জেরি আইসক্রিম ব্র্যান্ডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেরি গ্রিনফিল্ড, ডিজনির উত্তরাধিকারী অ্যাবিগেইল ডিজনি, চলচ্চিত্র পরিচালক রিচার্ড কার্টিস'সহ প্রমুখ। মাল্টি মিলিনিয়ারখ্যাত এসব ধনীদের প্রায় সকলেই ১০ লক্ষাধিক মার্কিন ডলারের বেশি বিত্তের অধিকারী।
জি-২০ দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানদের বৈঠকের আগে প্রকাশিত এই চিঠিতে 'বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিরসনে ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা' তুলে ধরা হয়।
মিলিওনিয়ার্স ফর হিউম্যানিটি বা মানবতার জন্য মিলিওনিয়ার শীর্ষক চিঠিটির অনুলিপি নিচে তুলে ধরা হলো;
মানবতার জন্য মিলিওনিয়ার
বিশ্ব নাগরিকদের প্রতি আমাদের বার্তা:
কোভিড-১৯ এর আঘাতে বিপর্যস্ত আমাদের পৃথিবী। ইতিহাসের এই মহাসঙ্কট কাল থেকে পৃথিবীর উত্তরণে আমাদের মতো মিলিয়নিয়াদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। একথা ঠিক, আমরা হাসপাতালের নিবিড় পরিচার্যা কেন্দ্রে গুরুতর অসুস্থদের সেবা করছি না। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে রোগীদের আনা হচ্ছে, আমরা তার চালকও নই। আমরা নিত্যপণ্যের চালান বিপণীকেন্দ্রের তাকেও সাজিয়ে রাখি না বা এগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজটাও আমরা করিনা। তবে হ্যাঁ, আমাদের কাছে বিপুল অর্থ আছে। এই অর্থই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সঙ্কটে আবর্তিত বিশ্বে আগামীদিনেও যার প্রয়োজন থাকবে।
আজ এই চিঠির নিচে স্বাক্ষরকারী মিলিয়নিয়াররা নিজ নিজ দেশের সরকারের প্রতি আমাদের মতো ধনী ব্যক্তিদের ওপর নির্ধারিত কর এই মুহূর্তে, বিপুল পরিমাণে এবং স্থায়ীভাবে বৃদ্ধির আহ্বান জানাচ্ছি।
কোভিড-১৯ যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে তার প্রভাব আগামী কয়েক দশকজুরে অনুভূত হবে। অতি-দারিদ্র্যের কবলে পড়বেন অর্ধশত কোটির বেশি মানুষ। কর্মসংস্থান হারাবে লাখ লাখ ব্যক্তি, কেউ কেউ চিরতরে বেকার হয়ে পড়বেন।
এই মুহূর্তে অর্ধশত কোটি শিশু বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেকের কাছে ঘরে বসে পাঠগ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার উপকরণও নেই। হাসপাতালের শয্যা, সুরক্ষা মাস্ক এবং ভেন্টিলেটরের সঙ্কট নিশ্চিতভাবেই বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের স্বল্পতার প্রাত্যহিক বেদনাদায়ক চিত্র তুলে ধরে আমাদের সামনে।
কোভিড-১৯ এই সঙ্কট তৈরিও করেছে, আবার স্বরূপও উন্মোচন করেছে। যত ব্যাপক পরিমাণেই হোক না কেন, শুধু অনুদান আর দাতব্যের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এ অবস্থায় সরকার প্রধানদেরই তহবিল সংগ্রহের বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিতে হবে। সুনিশ্চিত করতে হবে সংগৃহীত অর্থের যথাযথ ব্যয়।
আমাদের মতো বিশ্বের অন্যতম ধনীদের ওপর স্থায়ী কর বৃদ্ধি করা হলে; তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চলছে, তার সম্মুখভাগের যোদ্ধাদের কাছে আমরা বিপুল ঋণী। সম্মুখ সারিতে থাকা এই কর্মীদের অধিকাংশই ন্যায্য বেতন-ভাতা থেকে বহুগুণে বঞ্চিত। লড়াইয়ের প্রথম সারিতে আছেন আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা, যাদের ৭০ শতাংশই হচ্ছেন নারী। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কর্মক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করছেন। একইসঙ্গে, বিনা মজুরির গৃহস্থালি কাজের চাপ সামলাচ্ছেন। প্রতিদিন সাহসী এসব কর্মীরা বাকি সকলের সুরক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় যে ঝুঁকি নিচ্ছেন; তা আমাদের এক নতুন, কার্যকর ও বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপনের ডাক দিচ্ছে।
সমাজের একের প্রতি অন্য পেশার মানুষের এই নির্ভরশীলতার সম্পর্ক এখন অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি স্পষ্ট। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই পৃথিবীর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে আমাদের। ঠিকঠাক সবকিছু করার এই সুযোগ, দ্বিতীয়বার আর পাওয়া যাবে না।
কোটি কোটি পৃথিবীবাসীর ন্যায় আমাদের মতো ধনীদের চাকরি হারানোর উদ্বেগে ভুগতে হয় না। থাকতে হয় না- মাথা গোঁজার ঠাঁই বা পরিবারের জন্য চাহিদা মেটানোর দুশ্চিন্তায়। জরুরি অবস্থায় আমরা সম্মুখসারিতে দাঁড়িয়েও লড়াই করছি না। মহামারির কবলে সবকিছু হারানোর ঝুঁকি- আমাদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে কম।
তাই অনুরোধ করছি; আমাদের ওপর করারোপ করুন। করারোপ করুন। করারোপ করুন। এটাই একমাত্র উপায়।
কারণ দিনশেষে আমাদের বিপুল অর্থ-বৈভবের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো; মানবতা।