হাওরের আশ্চর্য অস্থায়ী গ্রাম
হাওর বেশ আশ্চর্য এক জায়গা।
বছরের ছয় মাস হাওর থাকে মিঠাপানিতে পরিপূর্ণ। যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই কেবল পানি আর দিগন্তের মাঝে গ্রামের দৃশ্য ভেসে ওঠে। আর এই সময়টাতে সেখানকার লোকজনের বসবাস ও বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড গ্রামের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে।
অন্যদিকে, পানি কমে গেলে বিস্তীর্ণ মাঠ পুনরায় জেগে ওঠে। তখন হাওর হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ। এছাড়াও, এই সময়ে পানিতে নিমজ্জিত রাস্তাগুলিও জেগে ওঠে; যোগাযোগের নেটওয়ার্ক আরও বিস্তৃত হয়। তখন হাওর এলাকা ঘুরে দেখাও বেশ সহজ হয়।
হয়ত মনে হতে পারে, জায়গাটি আপনার কাছে বেশ ভালোই পরিচিত। তবে একটু নজর দিলে সেখানে আপনি বেশকিছু ছোট 'গ্রাম' দেখতে পাবেন যেগুলি বন্যার সময় সেখানে ছিল না। কারণ এগুলো অন্য সাধারণ গ্রামের মতো নয়; বরং উঁচু জমির পরিবর্তে গ্রামগুলো হাওরের কোলে অস্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে।
এই অস্থায়ী 'গ্রামগুলোতে' প্রায়শই মাত্র কয়েকটি বাঁশের তৈরি ঘর থাকে। এগুলো শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য তৈরি করা হয় এবং বর্ষায় বন্যার আগে ভেঙে ফেলা হয়।
এগুলি হাওরের বাইরের আশেপাশের অঞ্চল থেকে আসা কৃষকেরা তৈরি করেন। স্থানীয়ভাবে যারা 'জিরাতি' নামে পরিচিত। এই কৃষকরা হাওরে তাদের নিজেদের জমিতে কিংবা শুধু লিজ নেওয়া জমিতে কাজ করেন। কিন্তু তাদের পরিবার এখানে থাকেন না। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা এসব বাড়িতে থাকেন ও জমি চাষ করে। পাশাপাশি দু-একটি গবাদি পশুও পালন করেন।
ফসল পেকে গেলে কৃষকেরা বন্যা শুরু হওয়ার আগেই সেগুলো সংগ্রহ করেন। মূলত নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওর জুড়ে এমন অস্থায়ী ঘর দেখা যায়।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কিশোরগঞ্জের হাওড়ে প্রবেশ পথের কাছে বালিখোলা ফেরি ঘাট পার হয়ে মিঠামইন ফেরি ঘাটের ঠিক আগে আমাদের সাক্ষাৎ হয় মো. মেরাজ এবং তার দুই ভাগনে, রফিক মিয়া ও জিন্নাত আলীর সাথে। যারা ঐদিনের মতো তাদের কাজ শেষ করছিল।
রফিক গরুগুলো বাড়িতে নিয়ে আসছিল। জিন্নাত তখন হাঁস পালতে ব্যস্ত ছিলেন। আর মেরাজ ধোঁয়া মোছার কাজ করছিল। তাদের এই কর্মযজ্ঞ হচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে চারটি ঘরকে কেন্দ্র করে; যেখানে তারা বাস করেন।
এই কৃষকেরা মূলত কিশোরগঞ্জ সদরের বৌলাই ইউনিয়নের বাসিন্দা। সকলেই পেশায় কৃষক। গত অক্টোবরের শেষ দিকে মোট পাঁচজন মিলে এখানে তারা ঘর নির্মাণ করেছিলেন।
৬০ বছর বয়সি কৃষক মো. মেরাজ বলেন, "এপ্রিলে বন্যা শুরুর সময় আমরা ফিরে যাব। গত বছর এখানে নয়টি বাড়ি ছিল।"
প্রতি বছরই ঘরগুলো মূলত স্ক্র্যাচ থেকে নির্মাণ করা হয়। ঘরগুলোতে থাকে টিনের ছাদ, বাঁশের বেড়া। সাথে কিছু আসবাবপত্র ও রান্নার জিনিসপত্রও থাকে। কৃষকরা সেচের জন্য একটি ডিজেল পাম্পসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত কৃষি সরঞ্জামও নিয়ে আসে। এমনকি পুরো মৌসুমের রান্নার জন্য তারা জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসেন।
মেরাজ জানান, বাড়ির অংশবিশেষ ও গবাদি পশুগুলো নৌকায় করে আনা হয়েছিল। তবে ফেরার সময় এগুলো নিয়ে যাওয়া হবে সড়কপথে, ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে।
সবমিলিয়ে পরিবারটির প্রায় ৩০ একর জমি রয়েছে। যেখানে তারা হীরা ২, হীরা ৭০, সাথী ইত্যাদি হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করেন।
ভালো ফলন হলে একর প্রতি ৭০ থেকে ৯০ মণ ধান পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে উৎপাদিত শস্যগুলো তারা কিশোরগঞ্জে নিজ বাড়িতে নিয়ে তারপর বাজারে বিক্রি করবেন।
কিছুটা দূরেই দেখা যায় ভুট্টার ক্ষেত। মেরাজ জানান, তার এলাকার অন্য কৃষকরা এগুলো চাষ করছেন।
তিনজন মিলে দুধ দেয় এমন আটটি গাভীও লালনপালন করছেন। কাছে জলাভূমি থাকায় তারা কিছু হাঁসও পালছেন।
মিঠামইন বা গোপদীঘির পাশের বাজারে চাষীরা দুধ বিক্রি করেন। তাদের বাড়ি থেকে মিঠামইন গোপদীঘির কাছাকাছি, যা দুই কিলোমিটার দূরে। তবে মাঝে একটি নদী আছে যেটি ফেরি দিয়ে পার হতে হয়।
রফিক ও জিন্নাত উভয়েরই বয়স প্রায় ৩০ বছর। তারা আট বছর বয়স থেকেই এই কাজ করে আসছেন। তাদের পূর্বপুরুষেরাও এর সাথে জড়িত ছিলেন।
জিন্নাত বলেন, "যখন আমার হাঁটার মতো বয়স হয়েছিল, তখন আমি আমার বাবার সাথে এখানে ঘুরতে আসতাম। তখন আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হতো, কারণ তলিয়ে যাওয়া রাস্তা তখন ছিল না।"
পরিবারের বাকি সদস্যরা নিজেদের গ্রামে বাস করেন। যা এই হাওর থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
জিন্নাত বলেন, "সন্ধ্যায় গবাদিপশু বাড়িতে নিয়ে আসি। এরপর আমরা যাত্রা শুরু করি। এশার নামাজের সময় বাড়িতে পৌঁছাই।" সেক্ষেত্রে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
রফিক বলেন, "যখনই প্রয়োজন হয় আমরা বাড়িতে যাই। সেক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে দুবার, এমনও হয়ে থাকে।"
কৃষকরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মিঠামইন বা গোপদীঘি থেকে কেনেন। কিন্তু তারা তাদের কুঁড়েঘরের ঢেউতোলা টিনের ছাদে লাউ ও বাড়ির উঠানে কিছু শাকসবজি চাষ করেন।
এক্ষেত্রে এলাকাটিতে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। যদিও কৃষকরা জানান, তারা সর্বদা নিরাপদেই আছেন। চুরি যাতে না হয় সেক্ষেত্রে তারা কুঁড়েঘরের ভিতরে গবাদি পশুর সাথে থাকেন। বাড়ির ভিতরে উঁকি দিলেই গবাদি পশুর গন্ধ টের পাওয়া যায়।
এক্ষেত্রে একটা জিনিস আমাদের বেশ মনে ধরে। সেটি হলো, কৃষকদের মুখের অবিরাম হাসি। কঠোর পরিশ্রম ও মৌসুমি অভিবাসনের পরও তারা বেশ আনন্দে আছেন।
অনেকটা আনন্দিত হয়ে রফিক বলেন, "সুখ ছাড়া মানুষ কীভাবে বাঁচতে পারে? আমরা যতক্ষণ মাটির উপরে আছি (মানে বেঁচে আছি), আমাদের সুখী থাকা দরকার।" তার চাচাতো ভাইও চড়া হাসি দিয়ে এর সাথে সম্মত হন।
অবশ্য এই কৃষকরা যে দরিদ্র, এমনটা নয়। যদিও তাদের পরনে ঐতিহ্যবাহী ও ব্যবহার্য পোশাক থেকে তা মনে হতে পারে। তবে হাওর ও গ্রামে তাদের প্রচুর উর্বর কৃষি জমি রয়েছে। যাইহোক, জলবায়ু সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে আকস্মিক বন্যা, মাঝে মাঝে তাদের আকাঙ্ক্ষিত ফসল থেকে বঞ্চিত করে। তখন তাদের গোটা পরিশ্রমই নষ্ট হয়ে যায়।
বয়স্ক কৃষক মেরাজ বলেন, "যখন বন্যা শুরু হয়, তখন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। ঐ সময়ে একটাই কাজ করার থাকে, তা হলো ঘর গুটিয়ে বাড়ি চলে যাওয়া।"
অষ্টগ্রামের কাছে আমরা একটি বৃহত্তর জনবসতি দেখতে পাই। যেখানে সমস্ত মৌসুমেই থাকা রাস্তার উভয় পাশে কৃষিজমির বিশাল অংশে প্রায় দশ হাজার বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
সেখানে সবজি বাগানে কাজ করছিলেন ১৬ বছরের ছেলে আরমান। তার ছোট ভাই, ১০ বছর বয়সী সোহাগ একটি সেচ খালে তিনটি মহিষ চরাচ্ছিলেন।
ছেলেগুলো সেখানে তাদের বাবা ও চাচার সাথে থাকে। যারা তখন কিশোরগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
আরমানের পরিবার এই জমির মালিক নয়; তারা লিজ নিয়ে এটি চাষ করেন। এক্ষেত্রে জমির মালিক কিছু জিনিসের দেখাশোনা করেন; যেমন বাড়ির জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা।
অষ্টগ্রাম-মিঠামইন সড়কের পশ্চিম পাশে আমরা কয়েকটি গরুর খামার দেখতে পেলাম। যা আমরা হাওরে অস্থায়ী ঘরবাড়িগুলোতেও দেখেছিলাম।
খুরশিদ মিয়া সেখানে ১৫টি মহিষ পালন করছিলেন। খুরশিদ ও খামারের মালিক জুলহাস ব্যাপারী দুজনেই খামারের কয়েক কিলোমিটার উত্তরে মিঠামইনে থাকতেন।
খুরশিদ ও তার সহকর্মীর জন্য এটি মূলত একটি অস্থায়ী বাড়ি। এর পাশেও মহিষ রাখার জন্য একটি চালা ছিল। রাতে মশার হাত থেকে মহিষদের রক্ষা করার জন্য শেডটি একটি মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা।
খুরশীদ বলেন, "রাতের কুয়াশা কেটে গেলে মহিষগুলো খোলা জায়গায় থাকবে। পশুগুলোর শুধু শীতকালে একটি আশ্রয়ের প্রয়োজন।"
খুরশীদ জানান, ঈদুল ফিতরের আগে মহিষগুলো বিক্রির জন্য বড় করা হচ্ছে। এরপর সেখানে তার চাকরি শেষ হয়ে যাবে। তখন ঢাকায় এসে রিকশা চালাবেন। তিনি কয়েক বছর ধরে রাজধানীর লালবাগ এলাকায় রিকশা চালাচ্ছেন।
খুরশীদ জানান, হাওরে পশুপালক হিসেবে কাজ করে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পান তিনি। তার কাজের মধ্যে রয়েছে রাতের জন্য মহিষের জন্য ঘাস কাটা, দিনে তাদের মাঠে বেঁধে রাখা এবং কাছের পুকুরে গোসল করতে নিয়ে যাওয়া। চারণভূমিটিতে সার দিয়ে প্রাকৃতিক ঘাস জন্মানো হয়।
আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন একটি মহিষ ছাড়া পেয়ে সেতুর নিচে থাকা একটি পুকুরের পানিতে দৌড়ে গেল। খুরশিদ তখন থামাতে ছুটে যান। তিনি দাবি করেন, অবৈধ জেলেরা পুকুরে বিষ প্রয়োগ করেছে। তাই মহিষগুলোকে সেখানে গোসল করা থেকে বিরত রাখতে হবে।
তখন আমরা খুরশীদকে বিদায় জানালাম। যাতে করে সে তার কাজ ঠিকভাবে করতে পারে।
অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের হাওরে আনুমানিক ৩৫ হাজার জিরাতি রয়েছে। যদিও এই অস্থায়ী বাড়িগুলি দেখতে ছোট গ্রামের মতো, তবে এগুলি এক অর্থে অসম্পূর্ণ। কারণ এখানে কোনও নারী বাস করে না। অবশ্য নারীরা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য দিনের বেলা ঐ বাড়িতে যান।