থাইল্যান্ড কিভাবে সংক্রমণের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত !
বিশ্বব্যাপী নতুন করোনাভাইরাসের মহামারি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের। উন্নয়নশীল দেশ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ; বাদ যাচ্ছেনা কেউই এর করালগ্রাস থেকে। এর মধ্যেই দক্ষিণপুর্ব এশিয়ার পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশ- থাইল্যান্ডে অতি কম মাত্রায় সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের মনে বিস্ময় উদ্রেক করেছে। জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।
থাই সংস্কৃতিতে একে-অন্যকে অভিনন্দন জানানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রথা রয়েছে। অন্যান্য সংস্কৃতির মতো হাত মেলানো বা কোলাকুলি করার চাইতে, বরং কিছুটা দূর থেকে বৌদ্ধিক কৃষ্টির প্রার্থনা জানানোর মতো করে দু'হাতের তালু একত্র করে 'প্রণাম' জানানোটাই প্রথা সেখানে। স্থানীয় সংস্কৃতিতে এই অভিবাদনের নাম 'ওয়েই'। ক্রমশ সংক্রমণ বিস্তার রোধে এই অভিবাদন রীতি কি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে?
নাকি বিশ্ব মহামারির প্রথম পর্যায় থেকে নেওয়া দেশটির সতর্কতামূলক পদক্ষেপসমূহ; যেমন মাস্ক ব্যবহার এবং তার পাশাপাশি চিকিৎসা খাতের উন্নত অবকাঠামোর অস্তিত্ব ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাবের রাশ টেনে ধরেছে? এক্ষেত্রে, অধিকাংশ থাই নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাপনও কি অবদান রেখেছে? নাকি তাদের অনেকের মাঝেই দুরোরোগ্য ব্যাধির হার কম থাকার মতো সংক্রমণ বিস্তারের পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সক্রিয় ভূমিকা রাখছে?
এসব অনুসন্ধানী প্রশ্নের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে; মেকং নদীর অব্বাহিকতায় অবস্থিত দেশগুলোয় আঞ্চলিক জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব থাই নাগরিক বা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে কিনা! সে প্রশ্ন। এ অঞ্চলের জলবায়ু এবং সংস্কৃতি কী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অধিকতর সক্ষম জেনেটিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে। নাকি আলোচিত সবগুলো বিষয়ের সম্মিলিত প্রভাবে মহামারি থেকে সুরক্ষিত আছে ৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটি?
জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নাকি আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রভাব:
গবেষণায় প্রমাণিত হওয়ার আগে প্রশ্নগুলোর উত্তর এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব না হলেও, একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হলো; চলতি বছরের শুরুতে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ হয়েছে- এমন দেশসমূহ থেকে বিপুল পরিমাণ পর্যটক আসা স্বত্বেও- থাইল্যান্ডে এপর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার ২৪০টি, মারা গেছেন ৫৮ জন। নতুন সংক্রমণের হারও একেবারে শূন্যের কোঠায়। গত বৃহস্পতিবার নাগাদ বিগত সাত সপ্তাহ ধরেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের এই অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
থাইল্যান্ডের মতো কম সংক্রমণ হার দেখা যাচ্ছে মেকং অববাহিকটায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি দেশে। এ অঞ্চলের দেশ ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আর গত তিন মাস ধরে দেশটিতে সামাজিক সংক্রমণ বিস্তারের কোনো ঘটনাও লক্ষ্য ওরা যায়নি। মেকং নদীর অববাহিকার অপর তিন দেশ মিয়ানমার, কম্বোডিয়া এবং লাওসে যথাক্রমে; ৩৩৬, ১৬৬ এবং ১৯টি সংক্রমণ ধরা পড়ে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রবেশের আগে মেকং নদী প্রবাহিত হয়েছে চীনের ইউনান প্রদেশের মধ্য দিয়ে। সেখানেও মাত্র ১৯০টি সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তবে ভাইরাস আক্রান্তরা সকলেই সুস্থতা লাভ করেছেন। ফলে সেখানেও নেই সক্রিয় কোনো সংক্রমণ।
এব্যাপারে থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ডা. তাওয়েসিন ভিসানুয়োথিন জানান, ''শুধুমাত্র জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে করোনা সংক্রমণ কম হচ্ছে, বলে আমি মনে করিনা। নিশ্চয় এর সঙ্গে সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কাউকে অভিনন্দন জানানোর সময় থাই নাগরিকেরা দূরত্ব বজায় রাখেন। শুধু থাইল্যান্ড নয়, মেকং অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলোর অধিবাসীরাও ঠিক এভাবেই পরস্পরকে অভিনন্দন জানান।''
ঝুঁকি স্বত্বেও নিরাপদ:
অথচ থাইল্যান্ডে ভয়াবহ মাত্রায় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি ছিল। গত জানুয়ারিতে চীনের বাইরে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে থাইল্যান্ডে একজনের দেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। তবে ওই ব্যক্তি ছিলেন একজন চীনা পর্যটক, ভাইরাসের উৎসস্থল বলে পরিচিত চীনের উহান নগরীর বাসিন্দা।
এরপর জাপান, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পর্যটকদের কারণে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ লক্ষ্য করে থাইল্যান্ড। বিপুল সংখ্যক পর্যটক অংশ নিয়েছিলেন এমন একটি বক্সিং প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানস্থল থেকে দ্বিতীয় ঢেউটি বিস্তার লাভ করে।
এরপর গত মার্চে দেশজুড়ে কঠোর লকডাউন চালু করে থাইল্যান্ড। বন্ধ করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তারপর থেকেই স্থানীয়দের মাঝে সামাজিক সংক্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। সাম্প্রতিককালে, থাইল্যান্ডে যাদেরকে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত করা হয়েছে, তারা সকলেই বিদেশি নাগরিক।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব নিয়ে গবেষণা:
দক্ষিণ থাইল্যান্ডের পাত্তানি প্রদেশে করোনাসংক্রমণ নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ ব্যাংককের চুলাংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. ওইপুত ফুলচারোইন। তিনি জানান,''এ প্রদেশে যাদের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশই ছিলেন উপসর্গহীন। স্বাভাবিকের তুলনায় যা অনেক বেশি। তাই আমরা এখন প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করছি।''
ডা. ওইপুত আরও জানান, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠী মশাবাহী ডেঙ্গু রোগের দ্বারা অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি আক্রান্ত হন।
''ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি এতটাই দুর্বল হয়; তাহলে কেন কোভিড- এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ সক্ষমতা শক্তিশালী হতে পারেনা'' প্রশ্ন রাখেন তিনি। একথার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু রোগের জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য অবদান রাখতে পারে; এমন ইঙ্গিত দেন তিনি ।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস