একটি বটির দাম ১০ হাজার টাকা!
হাজার দশেক টাকায় কী ধরনের বটি পাওয়া যায়? প্রশ্ন শুনে প্রায় আকাশ থেকে পড়েন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে লোহার তৈরি সরঞ্জামাদি বিক্রেতা আবু ইউসুফ। কামারশালায় হাঁপর টানা থেকে শুরু করে দোকান পরিচালনায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞ এ ব্যবসায়ী তিন হাজার টাকার বেশি দামের বটি কখনও তৈরি বা বিক্রয় করেননি।
অথচ একটি প্রকল্পে রান্নার জন্য ১০ হাজার টাকা দামের সবজি কাটার বটি কিনতে চায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। প্রতিটি বটিতে বাড়তি ব্যয় হবে সাত হাজার টাকা। ৩৬ বটি কেনায় ৩.৬ লাখ টাকা বরাদ্দের আড়াই লাখ টাকার বেশি গচ্ছা যাবে।
শুধু বটিই নয়, প্রকল্পটির খাবার প্লেট, প্লাস্টিকের বাটি, চামচ ও চালের ড্রামের মতো ছোটখাট পণ্যেও অস্বাভাবিক বেশি দাম ধরা হয়েছে। বাড়তি দাম প্রাক্বলন করা হয়েছে চেয়ার, টেবিল ও সোফার মতো আসবাবের। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট টেলিভিশন, এসি ও ফ্রিজের মতো ইলেক্ট্রিক পণ্যের দামও ধরা হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) এ সব বিষয় উঠে এসেছে। ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পেয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় অর্ধেক ভর্তুকি মূল্যে ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হবে। এর ফলে চাষাবাদে ৫০ শতাংশ সময় ও ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হবে। ফসলের অপচয় কমবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন পণ্যের দামের বাড়তি প্রাক্বলন দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাজার যাচাই না করে দাম প্রাক্বলন করায় সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই কেনাকাটায় দুর্নীতি হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
বিক্রেতা আবু ইউসুফ জানান, লোহার তৈরি বড় আকারের যন্ত্রপাতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বড় আকারের একটি বটির ওজন হতে পারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি। এ হিসাবে দাম থাকবে ৩ হাজার টাকার মধ্যে।
তিনি আরও বলেন, ১০ হাজার টাকার একটি বটির ওজন হবে ১০ কেজি থেকে সাড়ে ১২ কেজি পর্যন্ত। এ ধরনের বটি দিয়ে রান্নাঘরে সবজি কাটা সম্ভব হবে না বলেও তিনি জানান।
প্রকল্পে এক কেজি ধারণ ক্ষমতার প্রতিটি মসলা পাত্রের দাম ২ হাজার টাকা। ৯০টি মসলার পাত্র কিনতে মোট ব্যয় হবে ১.৮ লাখ টাকা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভালো মানের মসলাপাত্র সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিটি পাত্রের বাড়তি দাম ১৬০০ টাকা।
প্রকল্পটির আওতায় ৯০টি অ্যালুমিনিয়ামের চামচ কেনা হবে ৯০ হাজার টাকায়। প্রতিটির দাম এক হাজার টাকা। মাঝারী আকারের প্রতিটি চামচ ৫০০ টাকায় ও চা চামচ কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় হবে।
বাজারে সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় চা চামচ, ১৫০ টাকায় মাঝারী চামচ ও আড়াইশ টাকায় বড় চামচ বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ হিসাবে চামচে বরাদ্দ অর্থের দুই তৃতীয়াংশ থেকে তিন চতুর্থাংশ দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিং সেন্টারের ৭২০ টি প্লেট কেনায় ৭.২ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। প্রতিটির দাম পড়বে হাজার টাকা। আর হাফপ্লেটের দাম ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা করে।
বাজারে ভালো মানের সিরামিক প্লেট ২০০ টাকা ও উন্নত মানের চায়না বোন প্লেট ৪৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চেয়ারের দাম ৫০ হাজার টাকা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন ভাইস চ্যান্সেলর ৫০ হাজার টাকা দামের চেয়ার কিনে ব্যপক আলোচিত হয়েছিলেন। নতুন এ প্রকল্পে একই দামের চেয়ার কেনা হবে ৭২টি। আর এ জন্যে বরাদ্দ দেয়া হবে ৩৬ লাখ টাকা।
২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা দামে চেয়ার বিক্রি করে থাকে দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আখতার ফার্নিচার ও পারটেক্স গ্রুপ। এ হিসাবে চেয়ারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ।
কম্পিউটার সামগ্রীর দামেও নেই সামঞ্জস্য:
প্রকল্প বাস্তবায়নে ইন্টেল কোর আই-৫ প্রসেসর সমৃদ্ধ ১৪ ইঞ্চি মনিটরের পাঁচটি ল্যাপটপ কিনতে প্রতিটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১.৩০ লাখ টাকা।
এইচপি ব্র্যান্ডের আমদানিকারক স্মার্ট টেকনোলজিস বাংলাদেশ লিমিটেডের মাল্টিপ্ল্যান বিক্রয় কেন্দ্রে এমন কনফিগারেশনের ল্যাপটপের দাম ৫১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮৭ হাজার টাকা পর্যন্ত।
একই আমদানিকারক ডেল ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ বিক্রি করছে ৫১ হাজার থেকে ৮১ হাজার টাকার মধ্যে।
এ হিসাবে প্রতিটি ল্যাপটপে বাড়তি ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার থেকে ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা।
ল্যাপটপের দামে অসঙ্গতির বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠে এইচপি কোরআই-৭ প্রসেসরের ল্যাপটপের দাম প্রাক্বলনে। অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতার এ ল্যাপটপের দাম প্রাক্বলন করা হয়েছে ১ লাখ টাকা বা কোরআই-৫ প্রসেসরের চাইতে ৩০ হাজার টাকা কম।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রতিটি সাদাকালো প্রিন্টারের দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য কোনভাবেই আট হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম মাত্রা ছাড়া:
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানীর দেড় থেকে দুই টন ক্ষমতার ১০ টি এসির দাম ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটি এসির দাম পড়বে ২ লাখ টাকা।
বাজারে জেনারেল ব্র্যান্ডের দেড় টন এসি সর্বোচ্চ ৯৯ হাজার টাকা আর ২ টন এসি 108000 টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিটি এসির দাম বেশি ধরা হয়েছে ৯২ হাজার থেকে ১০১০০০ টাকা পর্যন্ত।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা:
বিষয়টি পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানকে জানানো হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'তাই নাই? এই তথ্য যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে প্রকল্পে তৈজসপত্রের যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আগামীকালই অফিসে গিয়ে কাগজপত্র দেখে ব্যবস্থা নিব আমি'।
তিনি জানান, কখনো কখনো প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেলে বিষয়গুলো ঠিক করা সম্ভব হয় না। তবে এক্ষেত্রে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দামের বিষয়টি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ঠিক করে নেওয়া হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষে প্রকল্পটির মূল্যায়নসহ অনুমোদনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছে কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
জানতে চাইলে বিভাগের সদস্য (সচিব) মোঃ জাকির হোসেন আকন্দ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কশিনের পক্ষ থেকে সাধারণত প্রকল্পের নীতিগত বিষয়গুলো দেখা হয়ে থাকে। কোন পণ্য কিনতে কত ব্যয় ধরা হয় তা দেখার দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের নয়।
তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম নির্ধারণ হয়। তবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অধিকাংশ পণ্য ও সেবা কেনাকাটায় করায় প্রতিযোগিতার কারণে বাড়তি দামের সমন্বয় হবে বলেও তিনি মনে করেন।
সাবেক সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আফিস-উজ-জামান, পরিকল্পনা কমিশন সব পণ্যের দামই খুটিনাটি দেখে। যে কোনো ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং উদ্যোগী মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চায়। সেক্ষেত্রে যদি তারা যদি যৌক্তিক ব্যাখা দিতে পারে, তবে তা অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে টেকনিক্যাল পণ্য বা ক্রয় কাজের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন জনবল নেই।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম প্রধান মোঃ রেজাউল করিম কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। বিষয় উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা দেয়া হলেও মোবাইল রিসিভ করেননি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মোঃ আবদুল মুঈদ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখার জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারি অর্থায়নে এইসমস্ত প্রকল্প পরিচালিত হয়। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ এই প্রকল্পগুলোকে তাদের দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের লাইসেন্স হিসেবে ধরে নেয়। আর এক্ষেত্রে বেসরকারি ঠিকাদার ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে এই দুর্নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে।
একের পর এক বালিশ বা পর্দার কেলেঙ্কারির মতো গভীর বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন চিন্তাই নেই যেন, তারা যেন এব্যাপারগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা শুধু প্রক্রিয়াগত এবং আইনীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, নৈতিকভাবেও তারা দেউলিয়া।
আর তাই এখন প্রতিযোগিতামূলক বাজারমূল্যের আলোকে নতুন করে বাজেট তৈরি করার পাশাপাশি প্রশাসনের দায়িত্ব হবে জাতীয় উদ্বেগজনক ও অবাস্তব এই বাজেট যারা প্রস্তুত করেছে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।