কোভিড সহায়তা তহবিল থাকা সত্ত্বেও আমরা সেগুলো ব্যবহার করিনি
গত বছরের জুনে ১০৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিতে এক সাথে তিনটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা ছাড় হয়ে গেলেও ৭৯৫ মিলিয়ন ডলারের অন্য দুই প্রকল্প এখনও নিতে পারেনি সরকার।
প্রায় আড়াই লাখ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে করোনা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য এই দুই প্রকল্প নেওয়ার কথা থাকলেও সরকারের ধীরগতির কারণে গত ১০ মাসেও ঋণচুক্তি হয়নি।
গত বছর মার্চে দেশে কোভিড শনাক্ত হওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও সরকারের বাজেট সহায়তা বাবদ বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ থেকে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান পাওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও প্রকল্প গ্রহণে ধীরগতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে মাত্র ১.৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে।
এর মধ্যে বাজেট সহায়তা বাবদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে সরকার। বাকি ৫.৮৪ বিলিয়ন ডলার প্রকল্প সহায়তা ও অনুদানের মধ্যে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৭০.৪৭ মিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে কোভিড মোকাবিলায় নেওয়া একটি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৩৭.৪৭ মিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানিখাতের বেকার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মান সরকারের ১৩৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান পাওয়া গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেট সহায়তা বাবদ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ছাড় হচ্ছে। তবে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন, দাতা সংস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত দরকষাকষিতে বাড়তি সময় ব্যয় হওয়ায় ঝুলে আছে প্রকল্প সহায়তা বাবদ দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ।
ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে ৮০০ মিলিয়ন ডলারসহ এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক নতুন প্রকল্পে প্রায় ২.৯৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে।
এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্পে ১.০৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। আর বিভিন্ন জটিলতায় ছয় প্রকল্পে ১.৮৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি এখনও আটকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের একটি প্রকল্পে জরুরী ভিত্তিতে ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র ৩৭.৪৭ মিলিয়ন ডলার। একই প্রকল্পের আওতায় ভ্যাকসিন কিনতে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেবে সংস্থাটি।
এ লক্ষ্যে একনেকের সভায় প্রকল্পটির সংশোধনী অনুমোদন দেয়া হলেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়নি। এর ফলে সরকারের টিকা ক্রয় কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে না।
গত বছরের জুনে অনুমোদন হওয়া বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের বেসরকারী বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা উন্নয়ন (প্রাইড) প্রকল্পে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের এনহান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট এন্ড ইকোনমি (এজ) প্রকল্পে ২৯৫ মিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সংশ্লিষ্টদের আয় পুনরুদ্ধারে একটি প্রকল্পে ২০০ মিলিয়ন ডলার ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি উন্নয়নে ১২০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
বোর্ডে অনুমোদন পাওয়া এ সব প্রকল্পের অর্থ ছাড় হলে করোনা সঙ্কট মোকাবিলা অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে করেন ইআরডির কর্মকর্তারা।
করোনা মোকাবিলায় সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ ও অনুদান বাবদ ৬০৭.২৩ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে সংস্থাটির ঢাকা অফিস সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে অনুদান হিসেবে আসবে ৭.২৩ মিলিয়ন ডলার।
বাজেট সহায়তা বাবদ সংস্থার ৫০০ মিলিয়ন ডলার সরকারের তহবিলে যোগ হয়েছে। আর ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণে নেয়া প্রকল্পে অগ্রগতি না থাকায় কোন অর্থ ছাড় হয়নি।
এছাড়া করোনা মোকাবিলায় পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে ছোট উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে ৫০ মিলিয়ন ডলার, পল্লী অঞ্চলের যোগাযোগ উন্নয়নে ১০০ মিলিয়ন, খুলনায় পানি সরবরাহে ১৬০ মিলিয়ন ডলারসহ মোট ১.১০ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করেছে এডিবি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে না আসায় এ সব প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়নি।
এ দিকে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে করোনা সংকট মোকাবিলায় এ পর্যন্ত ৮৫০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে চীনভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এআইআইবি। এর মধ্যে গত বছরের মে মাসে অনুমোদন করা বাজেট সহায়তার ২৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে সিএমএসএমই খাতের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে সংস্থাটি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে না আসায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের অপর দুই প্যাকেজ থেকে অর্থ ছাড় হয়নি।
জানতে চাইলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইং প্রধান আবদুল বাকি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এটা ঠিক যে প্রকল্প অনুমোদন ও চূড়ান্ত দরকষাকষিতে বিলম্বের কারণে কিছু প্রকল্পের ঋণচুক্তিতে বাড়তি সময় লাগছে'।
তিনি আরও বলেন, বেজা ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের দুই প্রকল্পের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পর অনেকটা সময় চলে গেছে। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্প দুইটি একনেকের অনুমোদনও পেয়েছে। চলতি মাসেই চূড়ান্ত মধ্যস্থতা শেষে ঋণচুক্তি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
করোনার ভ্যাকসিন কেনায় বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তিও এ মাসে হবে বলে তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, 'সুনির্দিষ্ট কোন খাত উল্লেখ না থাকায় বাজেট সহায়তার অর্থ ব্যয় করা অনেকটাই সহজ। আর বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় প্রকল্প সহায়তা পেতে বাড়তি সময় লাগে'।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে বলেন, 'করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউ, ভেন্টিলেটর এবং ওষুধ কেনায় বিপুল পরিমাণ অর্থের দরকার। নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার সামর্থ সরকারের না থাকায় বিদেশি সহায়তা আহরণ অপরিহার্য'।
তিনি বলেন, 'বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি আদায় করে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া প্রকল্প সহায়তা হিসেবে দাতাদের ঘোষিত বিদেশি সহায়তা দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে তা ফেরতও যেতে পারে'।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে নিয়ে এসে দ্রুত এ অর্থ ছাড় করার পরামর্শ দেন তিনি'।
ভ্যাকসিন কেনায় ২.৯১ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্রত্যাশা
দুর্নীতির অভিযোগে গত বছর কোভিড রোগীদের সহায়তায় নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট ও হাসপাতাল নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার দুটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ১০০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে নেওয়া ১১২৭ কোটি টাকার প্রকল্পের পিডি ড. ইকবাল কবিরের বিরুদ্ধে শুরুতে কেনাকাটায় অভিযোগ উঠার পর তিন জন পিডি নিয়োগ দিলেও তারা কোন কাজ করেন নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন।
অন্যদিকে, এডিবি ও এআইআইবির অর্থায়নে কোভিড মোকাবিলায় নেওয়া ১৩৬৫ কোটি টাকার প্রকল্পের পিডিও ছিলেন ড. ইকবাল কবির। গত এক বছরে এ প্রকল্পের কোন অর্থই খরচ করতে পারেনি সরকার। ফলে এডিবি ও এআইআইবি কোন অর্থও ছাড় করেনি।
এ অবস্থার মধ্যেই গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পটি সংশোধন করে ৬৬১৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন কেনাসহ স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা প্রত্যাশা করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর, যার ঋণ চুক্তি চলতি মাসেই হবে বলে আশা করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তিনি বলেন, 'ভ্যাকসিনের জন্য অর্থের কোন সংকট হবে না। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে। বরং সময়মত এসব অর্থের কতটা ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে'।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ইউরোপীয়ান ইনভেস্টমেস্ট ব্যাংকের সঙ্গে ২৫০ মিলিয়ন ইউরো (২৯৫ মিলিয়ন ডলার), ফ্রান্সের দাতা সংস্থা এএফডির সঙ্গে ১৭৬ মিলিয়ন ডলার (১৫০ মিলিয়ন ইউরো) সহায়তার বিষয়ে জোর আলোচনা চলছে।
ইআরডি'র ইউরোপ শাখার যুগ্ম সম্পাদক মির্জা আশফাকুর রহমান বলেছেন, 'করোনার টিকা কেনায় আর্থিক সহায়তা পেতে ইউরোপের সম্ভাব্য সবগুলো উৎসে যোগাযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপীয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ২৫০ মিলিয়ন ইউরো ও ফ্রান্সের এএফডি ১৫০ মিলিয়ন ইউরো দিতে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে'।
তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে ঋণচুক্তি সম্পন্ন হবে। মার্কিন ডলারের হিসাবে এই দুই সংস্থা থেকে পাওয়া যাবে ৪৭১ মিলিয়ন ডলার।
তবে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার কাছে পাঠানো ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রস্তাবের বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
ইআরডি'র জাপান শাখার যুগ্ম সম্পাদক মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুকও বলেছেন, 'জাইকার সঙ্গে ভ্যাকসিনে সহায়তার প্রসঙ্গে এখনও চূড়ান্ত কোন আলোচনা হয়নি'।
ভ্যাকসিন কিনতে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার বিষয়ে এখনও আশাবাদী সরকার।
ইআরডি এর মধ্যপ্রাচ্য শাখার যুগ্ম সম্পাদক কেএম শাহাবুদ্দিন টিবিএসকে জানান, 'আইডিবির কাছে মৌখিক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সংস্থাটি এ প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে'।