বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনে অভিনেতাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন রাজনীতিবিদরা
ভারতে চলছে লোকসভা নির্বাচন ২০২৪। কোলাহলপূর্ণ দেশটির রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। প্রায় দেড় মাস ধরে চলা গণতন্ত্রের এই বৃহৎ উৎসবে অংশ নেবেন প্রায় ৯৭ কোটি ভোটার।
জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলোর হাজার হাজার প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন তুমূল ব্যস্ত রাজনৈতিক বক্তৃতা, সমাবেশ এবং প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।
১ জুন পর্যন্ত চলা এই নির্বাচনে প্রায় ৯৭ কোটি ভোটার ভোট দেবেন যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি। লোকসভার মোট ৫৪৩টি নির্বাচনী আসনে সাত দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে আর ভোট গণনা হবে ৪ জুন।
এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রথম ধাপে (১৯ এপ্রিল) মোট ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১০২টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়। আর দ্বিতীয় দফায় (২৬ এপ্রিল) দেশটির ১৩ রাজ্যের ৮৮টি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চরম গ্রীষ্মের এ আবহাওয়া ভারতের রাজনৈতিক দল বা ভোটার কারোরই উদ্দীপনা খুব একটা কমাতে পারেনি। এই অসহ্য গরমের ভেতরেই রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের ভোট দিতে দেখা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য যেন আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিয়েছে, চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক, করছেন একে অপরকে দোষারোপ।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন 'ইন্ডিয়া' জোটের মধ্যে মূল লড়াই হতে যাচ্ছে। জোটগতভাবে ৪০০ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখছে ক্ষমতাসীন জোট এনডিএ। আর এককভাবে ৩৭০ আসনের টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে জোটটির মূল দল ভারতীয় জনতা পার্টি।
নরেন্দ্র মোদি আছেন টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়ের আশায়। আর রাহুল গান্ধী ২০টিরও বেশি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে আছেন মোদিকে আটকানোর চেষ্টায়। ভারতের জনগণের ভাগ্যে কী আছে তা হয়ত সময়ই বলে দেবে।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির নির্বাচনে পেশাদার রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি লড়াই করছেন অভিনেতা, ক্রীড়া তারকা এবং কোটিপতিরাও।
সংসদের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এখানে সবচেয়ে বেশি দেখা প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো তুলে ধরা হলো:
আমেঠি/ওয়ানাড়
আমেঠিতে রাহুল গান্ধী ফের সংসদে লড়বেন কি না, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে পারিবারিক শক্ত ঘাঁটি হারিয়েছেন তিনি। আমেঠির গান্ধী ও তার পরিবারকে নির্বাচিত করার ইতিহাস থাকলেও এবার অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এদিকে, রাহুল গান্ধী কেরালার ওয়ানাড় থেকেও প্রার্থী হয়েছেন, যেখানে তিনি গতবার জিতেছিলেন। ওয়ানাড় কেন্দ্র থেকে গত নির্বাচনে ৪.৩১ লাখ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। রাহুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এবার এখানে নির্বাচনের মাঠে আছেন বিজেপির কে সুন্দরন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) অ্যানি রাজা।
সংসদে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য ভারতে রাজনীতিবিদদের একাধিক আসন থেকে ভোটে দাঁড়ানো খুব সাধারণ বিষয়।
কিন্তু রাহুলের দল এখনও আমেঠিতে প্রার্থী ঘোষণা না করায় নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালে সেখানে গান্ধীকে পরাজিত করা স্মৃতি ইরানি এবারও লড়ছেন। তবে সেখান থেকে কে এবার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন তা আগামী ২০ মে-ই নির্ধারণ করে দেবে।
রায়বরেলি
রায়বরেলি থেকে গত পাঁচটি নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস দলের প্রাক্তন সভাপতি সোনিয়া গান্ধী এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমেঠি থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার (৩৭.২৮২ মাইল) পশ্চিমে অবস্থিত এই নির্বাচনী এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে গান্ধী পরিবারের আধিপত্য রয়েছে, তার প্রয়াত শাশুড়ি এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও এই আসন থেকে তিনবার জিতেছেন।
দল এখনও কারও নাম ঘোষণা না করায় সোনিয়া কন্যা প্রিয়াঙ্কা এই আসনে প্রার্থী হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবার, প্রিয়াঙ্কার চাচাতো ভাই বরুণ গান্ধীকে তার নির্বাচনী এলাকা পিলিভিট থেকে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ না দেওয়ায় মোদির বিজেপি তাকে প্রার্থী করতে পারে বলে ভারতীয় কয়েকটি সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
লাদাখ
তুষারাবৃত হিমালয় শৃঙ্গ এবং শান্ত হ্রদের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এ অঞ্চলে হর হামেশাই সীমান্তে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ক্রমবর্ধমান স্থানীয় অসন্তোষের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি এখানে তৃতীয়বারের জন্য জয়ী হতে চায়।
একসময় জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ লাদাখ ২০১৯ সালে মোদি সরকার তার স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহারের পরে দুটি ফেডারেল নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিভক্ত হয়। এরপর থেকে লাদাখ আলাদা রাজ্যের মর্যাদার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। এর নেতৃত্বে আছেন জলবায়ু কর্মী সোনম ওয়াংচুক, যিনি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে পরিবেশগত সংরক্ষণের জন্যও পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর প্রকাশ্যে দলের বিরোধিতা করায় বিজেপি ২০১৯ সালের বিজয়ী জামিয়াং সেরিং নামগিয়ালের পরিবর্তে নতুন প্রার্থী বেছে নিয়েছে।
তিরুবনন্তপুরম
সুন্দর সমুদ্র সৈকত, জলাশয় এবং আয়ুর্বেদের জন্য বিখ্যাত কেরালা রাজ্যের রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে তিনটি দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে।
প্রাক্তন মন্ত্রী তথা কূটনীতিবিদ, কংগ্রেসের শশী থারুরের লক্ষ্য টানা চতুর্থ জয়। বিজেপি জুনিয়র টেকনোলজি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখরকে প্রার্থী করেছে থারুরকে পরাজিত করতে। এই কেন্দ্রে বাম পন্থী দল সিপিএমের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন পান্নিয়ান রবীন্দ্রন।
ভারতের একমাত্র রাজ্য কেরালা, যেখানে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কখনো একটি আসনও জেতেনি। এ রাজ্যে বরাবরই বাম-কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন দিয়ে এসেছে জনগণ।
কোয়েম্বাটুর
'দক্ষিণ ভারতের ম্যানচেস্টার' নামে পরিচিত, তামিলনাড়ুর এই শিল্প শহরটি সংসদীয় নির্বাচনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিজেপির প্রভাব বাড়ানোর মোদির লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দু।
কয়েকটি আসন জিততে মরিয়া বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলোর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কে আন্নামালাইকে প্রার্থী করেছে। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে প্রচারণা চালানো আন্নামালাই সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। আর মোদি দলের সম্ভাবনা বাড়াতে চলতি বছরে ছয়বার এ রাজ্যে এসেছেন।
কৃষ্ণনগর
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার উত্তরে একটি ছোট্ট শহর চলমান জাতীয় নির্বাচনের অন্যতম তীব্র রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। বিজেপি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়ের জন্য কোনও প্রয়াস ছাড়েনি। তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই আসন থেকে তার দলের প্রার্থী হলেন জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোম্পানির প্রাক্তন ব্যাঙ্কার মহুয়া মৈত্র, যিনি মোদি ও তার দলের কট্টর সমালোচক। গত বছর 'অনৈতিক আচরণের' অভিযোগে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয় মহুয়া মৈত্রকে।
বিজেপি প্রার্থী করেছে শহরের প্রাক্তন রাজপরিবারের সদস্য অমৃতা রায়কে।
বারামতি
মুম্বাই থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই সংসদীয় আসনটি মহারাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ শরদ পাওয়ারের পারিবারিক ঘাঁটি হিসাবে বিবেচিত হয়। তার মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এই আসন থেকে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচন করতে চাইছেন।
তবে এবার প্রতিযোগিতা তীব্র হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার এর আগে তার চাচার দল থেকে বিভক্ত হয়ে বিজেপিতে জোট বেঁধেছিলেন এবং রাজ্য সরকারে তাকে উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি এবার তার স্ত্রী সুনেত্রা অজিত পাওয়ারকে সুপ্রিয়া সুলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনীত করেছেন। অজিত ও সুনেত্রা উভয়কেই উল্লেখযোগ্য আর্থিক কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত মামলায় তদন্তকারী সংস্থাগুলো ছাড়পত্র দিয়েছে।
বাড়মের
পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানের মরু শহর বাড়মেরে এক তরুণ স্বতন্ত্র প্রার্থী ২৬ বছর বয়সী ছাত্রনেতা রবীন্দ্র সিং ভাটি আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। গত দুটি নির্বাচনে এই আসনে জয়ী হয়েছে বিজেপি। পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘ সীমানা ভাগ করে নেয়া শহরটি ভারতের অন্যতম উষ্ণতম স্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা প্রায়শই ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)-এ পৌঁছায়।
রবীন্দ্র সিং ভাটি ২০২৩ সালে বিজেপি রাজস্থানের নেতৃত্বে বিজেপিতে যোগ দেন । তবে শিও নির্বাচনী এলাকা থেকে মনোয়নন না দেওয়ায় মাত্র এক সপ্তাহ পরেই দল ছাড়েন তিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রাজস্থান বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি এবারও স্বতন্ত্র হয়ে লড়ছেন এবং বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়কেই চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন