খাবার পানিও যখন সেবার দৃষ্টান্তে পরিণত হয়
প্রচণ্ড গরমে যখন ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছল, মোহাম্মদ কালামের গলা ততক্ষণে শুকিয়ে কাঠ।
রিকশার প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে রাখা দুই বোতল পানি সেদিন দুপুরের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১টা ছুঁতেই তিনি সাতমসজিদ রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে মরিয়া হয়ে পানির কল খুঁজতে লাগলেন।
তখনই হঠাৎ তার একটা জায়গার কথা মনে পড়ল। তাৎক্ষণিক ধানমন্ডি ৮/এ অভিমুখে রওনা দিলেন এবং ৬৭ নম্বর বাড়িতে পৌঁছালেন তিনি। এই বাড়ির দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে 'ফিল্টার পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার' লেখাটি, এর নিচে দুটো পানির কল। কল দুটো থেকে বিনামূল্যে ঠান্ডা পানি বিতরণ করা হচ্ছে।
কালামের কাছে এটা শুধু অন্যের সামান্য একটু উপকার করাই না, এটা 'আল্লাহর ইবাদতের মতো'।
পানি তিন ধাপে পরিশোধন করা এবং বৈদ্যুতিক কুলিং মেশিন লাগানো পানির এই ফিল্টারটি গত বছর থেকে ঢাকার প্রচণ্ড গরমে অনেক মানুষের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে।
এক ঢোকে অনেকটা পানি খেয়ে নিয়ে কৃতজ্ঞতাভরে কালাম বলেন, 'আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন।'
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি তার মুখ আর ক্লান্ত চোখে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দিলেন, এরপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের বোতল ভরার জন্য জায়গা দিলেন।
আরেক রিকশাচালক মনসুর হোসেন কালামের কথার প্রতিধ্বনি করে এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'গত বছর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পথচারীদের সমাজসেবার অংশ হিসেবে জমির মালিক ফিল্টার স্থাপন করেন।'
এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে, একই রাস্তায় আরও দুটি বাড়ির (হাউস নম্বর ৭৭ এবং ৭৪) মালিকও একই রকম দুটো ফিল্টার বসান। এমনকি এর একটিতে বোতল না আনা মানুষদের জন্য, সেখানে থাকা প্লাস্টিকের কাপে পানি পান করার সুযোগ আছে।
সিগারেট বিক্রেতা মাহমুদুল হক এটিকে একটি অনন্য উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, পিকআপ চালক সাদ্দাম হোসেন গরম থেকে রেহাই পেতে দুপুরে খাওয়ার জন্য বোতলে পানি ভরে নিলেন।
তিনি বলেন, আমি মাত্র ১০ মিনিট হয় এখানে এসেছি, এরই মধ্যে আমি অন্তত ১৭ জনকে কল থেকে পানি নিতে বা পানি পান করতে দেখলাম।
শুধু এই রাস্তায়ই নয়, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শহর জুড়ে অসংখ্য বাড়ির মালিক একই রকম উদারতা দেখিয়েছেন।
যেমন: উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির সামনে একটি পানির ফিল্টার আছে। এটি স্থাপন করেছেন একজন নারী।
তিনি পানিতে বরফ মিশিয়ে দিয়েছেন, যাতে গরমে সবাই শীতল পানি পান করতে পারে।
তিনি নিজে কথা বলতে রাজি না হলেও,তার বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মামুন সরকার বলেন, 'ম্যাডাম খুবই ধার্মিক। সবার জন্য তার হৃদয়ে মায়া-মমতা আছে, এমনকি পাখিদের জন্যও। তিনি তার বারান্দায় পানি রাখেন যাতে পাখিরা সেখান থেকে পানি পান করতে পারে।'
আমি আর আমার রিকশাচালকও এই ফিল্টারের পানি পান করে তৃষ্ণা মেটালাম।
উত্তরায় এরকম আরও বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। যেমন একই সেক্টরের ২৯ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়িতে গত বছর থেকে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
আবুল হোসেন নামের এক সবজি বিক্রেতা এখান থেকে পানি নিয়ে মুখ ধোয়ার পাশাপাশি, তার সবজিতেও পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন।
একইভাবে, উত্তরা ২৭ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়ির গেটের বাইরে একটি ছোট পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে, ১৭ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির ভিতর থেকে একটি লম্বা পাইপের মাধ্যমে বাইরের কলে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ১৮ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর বাড়িতে একটি ফিল্টার বসানো হয়েছে এবং পানি পান করার সুবিধার জন্য একটি মগও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
উত্তরার অন্যান্য সেক্টরের আরও কয়েকটি বাড়িতেও মানবসেবার এই দৃষ্টান্ত রয়েছে।
এমনকি একটি জায়গায় পানির পাত্রের উপরে একটি বয়ামে বিস্কুটও রাখা দেখলাম।
উদারতার এই চেতনা শুধু উত্তরা এলাকাতেই দেখা যায় তা কিন্তু নয়, রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় একই ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।
গুলশানের দ্য ওয়েস্টিন হোটেলের ঠিক উল্টোদিকে এবং গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালের পাশে বিনামূল্যে খাওয়ার পানির কল আছে।
এছাড়া সম্প্রতি বনানী, বনশ্রী ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়ও বিনামূল্যে খাওয়ার পানির কল বসানো হয়েছে।
ধানমন্ডি ৮/এ এর ৬৭ নম্বর বাড়ির ছবিসহ এই মহানুভবতার কথা সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এবং মানুষ এ কাজের ভূয়সী প্রশংসা করছে।
আমার রিকশাচালক যেমনটা বলেন, 'যদি একটা পানির কল থেকে অন্যরা উপকৃত হয়, তবে এই একটি ভাল কাজের ফল আল্লাহ অন্যভাবে তার (যিনি কলটি স্থাপন করেছেন) জীবনে ফিরিয়ে দেবেন।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি