দেশের ৯৪% বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ৮৯% লাইট পণ্যের বাজার স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর দখলে
দেশের ইলেকট্রিকাল বাজারে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্যই সবচেয়ে বেশি। বাজারের ৯৪ শতাংশ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং ৮৯.১ শতাংশ লাইট (বাতি) পণ্য স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোই সবরাহ করে থাকে বলে উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ (এমডব্লিউবি)- এর নতুন এক সমীক্ষায়।
শনিবার (২৮ মে) প্রকাশিত গবেষণাটিতে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং লাইট পণ্যের বাজারের আকার ৬,০০০ কোটি টাকা। এবং এই বাজারের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১১.৫ শতাংশ।
বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যেমন— সুইচ, সকেট, হোল্ডার, প্লাগ ইত্যাদির বাজার ৩,৩০০ কোটি টাকা– যেখানে লাইট বা আলোক পণ্য যেমন— এলইডি, টিউব, ইমার্জেন্সি লাইট, জিএলএস বাল্ব ইত্যাদির বাজার ২,৭০০ কোটি টাকা।
এক দশক আগেও এই বাজারের আকার ছিল প্রায় ২,২০০ কোটি টাকা; তবে স্থানীয় ব্র্যান্ড বৃদ্ধি ও বিদ্যুতায়নের প্রভাবে দশকের ব্যবধানে বাজারের আকার এখন তিনগুণ বেড়েছে।
উভয় ক্ষেত্রেই শীর্ষ স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে সুপার স্টার, ওয়ালটন, ক্লিক এবং এনার্জিপ্যাক। গবেষণার তথ্যমতে, ফিলিপসের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাজারের সামান্য অংশই ধরে রাখতে পেরেছে।
এমডব্লিউবি-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মো. নাজমুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের উত্থানের আগে বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র গ্রে মার্কেট থেকে আনা হতো বা আমদানি করা হতো।
তিনি বলেন, "গত এক দশকে, স্থানীয় ব্র্যান্ডের শেয়ার বেড়েছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং আলোক পণ্যের বাজারের ৫৩ শতাংশই এখন ব্র্যান্ডেড, আর বাকি ৪৭ শতাংশ নন-ব্র্যান্ডেড।"
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগের ২,০১৬ জন খুচরা ব্যবহারকারী বা ভোক্তা, ১০৩ জন খুচরা বিক্রেতা, ৯৯ জন ইলেকট্রিশিয়ান এবং ৫ জন শিল্প বিশেষজ্ঞের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণার জন্য ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে।
সুপার স্টার গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার মো. তোফায়েল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের গ্রুপের জার্নি ১৯৯৩ সালে জেএনএস বাল্বের মাধ্যমে হয়। এরপরে ধীরে ধীরে আমরা ইলেকট্রিক্যাল এক্সেসরিজ (বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম) এবং লাইটিং পণ্যে ইনভেস্ট করেছি। তবে আমাদের ২০০৫-২০০৬ সালের পর থেকে ব্যাপক আকারে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় ব্রান্ড হিসেবে আমরা সুইচের ভিতরের তামার কাজও দেশের কোম্পানিতেই করে থাকি।"
তিনি বলেন, "আমরা ১০০% কমপ্লায়েন্স মেইন্টেইন করে প্রডাক্ট তৈরি করি। ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে যেসব কমপ্লায়েন্স মেইন্টেইন করা দরকার হয়, আমরা সেসব শর্ত পূরণ করে ভারতেও পণ্য রপ্তানি করি। সাথে সাথে আইএসও কমপ্লায়েন্সও মেইন্টেইন করা হয় আমাদের পণ্যের ক্ষেত্রে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫-২০ শতাংশ। এছাড়া, গবেষণায় যে মার্কেট শেয়ারের হিসাব উঠে এসেছে, বাস্তবে আমাদের মার্কেট শেয়ার তার থেকেও বেশি আছে। মার্কেটের ৫০ শতাংশের বেশি রিটেইল কাভারেজের আন্ডারে সুপার স্টার।"
দেশীয় ব্রান্ড জনপ্রিয় হওয়ার আগে ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের গ্রে প্রোডাক্ট ইলেট্রিক্যাল এক্সেসরিজের জায়গা দখলে ছিল। এছাড়া বিদেশি কোম্পানি ফিলিপসের দখলে ছিল লাইটের বাজার– যা এখন অধিকাংশই দেশীয় ব্রান্ডের দখলে।
ওয়ালটনের ব্র্যান্ড ম্যানেজার জাকিবুর রহমান সেজান বলেন, "একটা সময় এই মার্কেটের পুরোটাই গ্রে মার্কেটের দখলে ছিল। গত কয়েকবছরে দেশীয় কোম্পানিগুলো এসব প্রডাক্ট উৎপাদন করায় লোকাল ব্রান্ডগুলোর প্রতি মানুষ আস্থা রাখছে। ওয়ালটনের ইলেকট্রিক্যাল এক্সেসরিজের মার্কেট শেয়ার প্রায় ১০-১২ শতাংশ।"
এমডব্লিউবির আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান বলেন, এই বাজারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, মোট মার্কেট শেয়ারের প্রায় অর্ধেক নন-ব্যান্ডেড, অর্থাৎ নিম্নমানের নকল ও অনুমোদনবিহীন পণ্য দখল করে আছে। যেহেতু দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি, তাই আগামী দিনগুলোতে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজারে আরও বেশি আধিপত্য বিস্তার করবে।
তিনি বলেন, "এই শিল্পের অগ্রগতির পেছনে মূলত গত ২৫ বছরে ব্যাপক বিদ্যুতায়ন, অব্যাহত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান আয়, দ্রুত ও পরিকল্পিত নগরায়ণ, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সরকারের গৃহীত সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে।"
দুর্দান্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য গ্রে-মার্কেটের কার্যক্রম হ্রাসে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি এ সমস্ত শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ গড়ে তোলার জন্য সরকার এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গবেষণায় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের প্রধান সমস্যাগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রায় ২৩ শতাংশ বৈদ্যুতিক সমস্যা লুজ কানেকশন এবং ২০ শতাংশ সমস্যা হয়ে থাকে শর্ট সার্কিট থেকে। এরপরে রয়েছে— মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য, অতিরিক্ত গরম হওয়া, পুরানো ডিজাইন, সুইচ প্লেট জ্বলে যাওয়া এবং ভেঙে যাওয়া ইত্যাদির মতো সমস্যাগুলো।
গবেষণা সংস্থাটির মতে, এই শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো গ্রে-মার্কেটের আধিপত্য; এছাড়া রয়েছে— অসম প্রতিযোগিতা, ব্র্যান্ড সচেতনতার অভাব, সাপ্লাই চেইন এবং মান নিয়ন্ত্রণ, নীতি ও নিয়ন্ত্রক ল্যান্ডস্কেপ এবং শিল্পে খুচরা বিক্রেতা ও ইলেকট্রিশিয়ানদের অযাচিত আধিপত্য।
সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে, ১,৫০,০০০ খুচরা বিক্রেতা এবং ২,৫০০ ছোট ব্যবসাসীসহ মোট ৫,০০,০০০ বেশি মানুষ এই বৈদ্যুতিক শিল্পের সঙ্গে জড়িত।