শীত আসছে, কিন্তু চীন-ভারত সীমান্তে দুপক্ষই অনড়
গণমাধ্যমে প্রকাশিত মুখরোচক খবর হচ্ছে; লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার দুপাড়ে চীনা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমন। কিন্তু, সংঘাত উৎসের বাস্তবতা নির্দেশ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। আসল সত্য হচ্ছে, গালোয়ান উপত্যকার আগেই চলতি বছর দুই পক্ষের সেনাদের মাঝে হাতাহাতি ঘটেছিল। গত ১৫ জুনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছিল কেবলমাত্র চলমান উত্তেজনার সর্বোচ্চ পরিণতি মাত্র।
গালোয়ানের পরে উভয়পক্ষ থেকেই আরও বিস্তৃত সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি কমাতে, উত্তেজনা প্রশমন এবং সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। উভয় দেশের শীর্ষ কূটনীতিবিদেরা যেমন আলোচনায় অংশ নেন, তেমনি জেনারেল পর্যায়েও আলোচনা হয়। এরপর, সেনা সরিয়ে আনার যৌথ ঘোষণাও দেওয়া হয়। কিন্তু, গালোয়ানে আসলে কী ঘটছে?
বেশিরভাগ নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক এবং ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রেই জানা গেছে যে, উভয় পক্ষই বিরোধপূর্ণ সীমান্তে নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম এবং সেনা উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে। প্রতি সপ্তাহেই সমর প্রস্তুতিতে যোগ হচ্ছে যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, দূরপাল্লার মর্টার, হাউৎজার কামান এবং মাল্টিপল রকেট লঞ্চারের মতো ভারি ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাস্ত্র।
২০১৭ সালে ভূটানের দোকলাম মালভূমিতে উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর মধ্যে টানা ৭২ দিনের যে মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, তাকেও ছাড়িয়ে গেছে চলতি বছর টানা ১৩ সপ্তাহের পারস্পরিক চোখ রাঙানি।
এসময়ের মধ্যে হয়েছে নয় দফায় কূটনীতিক এবং সামরিক পর্যায়ে বিরোধ নিরসনের আলোচনা। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই'র সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা করেছেন তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ এস. জয়শঙ্কর। কথা বলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও।
এই প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন জানান, সীমান্তে উভয় সামরিক বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান থেকে সরে গেছে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ওই অঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ নিরসনের পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি, এমন আভাসও দেন।
প্রকারান্তরে চীন সাইনো-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের নিরাপত্তার জন্য গালোয়ানের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থেকে যে পিছিয়ে আসতে পারবে না, সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে। আবার চীনকে ঠেকানো এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট রাখার দ্বৈত উদ্দেশ্য থেকেও, সিপিইসি প্রকল্প- যে কোনো মূল্যে থামাতে চায় ভারত। এর মাধ্যমে চির বৈরী পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের ইচ্ছে অঙ্কুরেই বিনাশের অভিলাষ ভারতের।
আবার গত ১৫ জুন চীনা সেনাদের হাতে ২০ ভারতীয় সেনার মৃত্যুতেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুতীব্র এবং ধারাবাহিক চাপের মুখে রয়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার।
প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পি.চিদাম্বরম তো বলেই বসেছেন, চীন নাকি নরেন্দ্র মোদির নাকের ডগায় ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যেই দখল করে নিয়ে বসে আছে।
অভ্যন্তরীণ চাপ সংঘাতের প্রবল ঝুঁকি স্বত্বেও মোদি সরকারকে বাধ্য করেছে, সেনা প্রস্তুতি জোরদার করতে।
বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক সারাংশ দেন ওয়াং ওয়েনবিন। তিনি বলেন, ''বর্তমানে যে অবস্থা চলছে-তাতে পরিস্থিতি কখনো বিস্ফোরক রূপ ধারণ করে, কখনোবা বরফ শীতল অবস্থায় রূপ নেয়।''
আক্ষরিক অর্থেই দীর্ঘমেয়াদি এ সীমান্ত বিরোধ সেদিকেই রূপ নিতে পারে। অন্তত, আসন্ন শীতের আগেও সম্পর্কের বরফ গলার আশা করছে না কেউই।
ভারতীয় সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্র ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, উভয়পক্ষে যেভাবে রণসজ্জা বাড়ানো হয়েছে, তাতে সেখান থেকে সেনা ও সরঞ্জাম প্রত্যাহার করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ প্রস্তুতি থেকে পিছিয়ে আসতেও সময় লাগবে।
মঙ্গলবার চীনা মুখপাত্রের বিবৃতির প্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বটে। তবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য এবং দেশটির সামরিক বিশেষজ্ঞরাও গণমাধ্যমের কাছে অচিরেই সীমান্ত উত্তেজনা লাঘব হবে না, এমন আভাস দিয়েছেন।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-ও সম্প্রতি জানান, তিনি (চীনের সঙ্গে আলোচনার) 'চূড়ান্ত ফলাফলের' গ্যারান্টি দিতে পারবেন না। চীনা সেনারা নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করছে না- এমন দাবি করে- ভারতীয় গণমাধ্যম রাজনাথের বক্তব্যের আগেই জানায়, এর ফলে উত্তেজনা নিরসনের সম্ভাবনা দূর হয়ে যাচ্ছে।
তবে উত্তেজনা নিরসনে ভারতের একক আগ্রহ, এমনটা সত্য নয়। বরং চীনের সঙ্গে আলোচনার তলে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের মাত্রা বাড়িয়েছে ভারত। চলতি মাসেই দেশটির সামরিক বাহিনী ৪ কোটি ডলারের একটি ক্রয় অনুমোদন করে। চুক্তিটি এখনও প্রকাশিত না হলেও, এর আওতায় কেনা হচ্ছে; নজরদারি ড্রোন, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, অ্যাসল্ট রাইফেল নিত্যাদি। জরুরি ক্রয়ের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উত্তর সীমান্তে অবনতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্ট প্রয়োজনীয়তাকে।
আগামী অক্টোবরেই হিমালয় অঞ্চলে নামবে তীব্র শীত। এমন আবহাওয়ায় তাপমাত্রা কখনো কখনো হিমাঙ্কের ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নিচে নামে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে যেকোনো সংঘর্ষ বিপুল প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
গত মাসের সংঘর্ষে কোনো গুলি না চললেও, তাতে ২০ ভারতীয় সেনা প্রাণ হারায়। চীনের পক্ষেও হতাহত হলেও, সংখ্যা জানানো হয়নি। কিন্তু, এবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপেই খালি হাতে লড়াইয়ে সেনাদের পাঠানোর পক্ষপাতি নয় ভারত। এবার সংঘাত হলে তাই যেমন গুলি চলবে, তেমনি হিমালয়ের শৃঙ্গতলে গগন নিনাদে ফেটে পড়বে শক্তিশালী কামানের সারি।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র বলে পরিচিত সিয়াচেন হিমবাহ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৬ হাজার ৭শ' মিটার। এ যুদ্ধক্ষেত্রে অধিনায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতীয় সেনার প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সঞ্জয় কুলকার্নি। তিনি খারাপ আবহাওয়ার দরুণ ভুল করেই সংঘাত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা করছেন।
''তুষারঝড় চলাকালে হিমালয়ের উঁচু রণক্ষেত্রে একমিটার সামনের কিছুও দেখা যায়না। এ অবস্থায় টহলরত দুই পক্ষের সেনা একে-অপরের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। পথ হারিয়ে একে-অন্যের সীমানায় প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় যদি কোনো সমঝোতা না হয় এবং উভয়পক্ষ টহলের সময় আবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তবে নিঃসন্দেহে রক্ত ঝরবে, যা উত্তেজনা নিরসন নয় বরং এক প্রাণঘাতী আবহের জন্ম দেবে'' বলেন তিনি।
- লেখক পরিচিতি: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক
- অনুবাদ: নূর মাজিদ