উচ্চ আদালতে কেন এত মামলা হারছে সরকার?
মানসম্মত জবাব, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা যথাযথ গ্রাউন্ডস উপস্থাপনে ব্যর্থতা এবং তামাদি হওয়ার কারণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরগুলো উচ্চ আদালতে অনেক মামলায় হেরে যাচ্ছে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কমিটির পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ-পর্যায়ের ওই কমিটির কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে মামলা হেরে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে কমিটির সদস্যরা মনে করেন, এসব কারণের সাথে বিভিন্ন দপ্তরের আইন বিভাগের কর্মীদের অদক্ষতা, কাজের প্রতি গাফিলতির কারণেও অনেক মামলায় হেরে যাচ্ছে সরকার।
'উচ্চ আদালতে চলমান সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনা কার্যক্রম পরিবীক্ষণ সংক্রান্ত আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি'-এর ষষ্ঠ সভার কার্যবিবরণীতে সরকারি পক্ষের মামলায় হেরে যাওয়ার এসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। গত ২৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে ১৭১টি মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে। আর একই সময়ে আগে বিপক্ষে যাওয়া ৪৪১টি মামলায় আপিল দায়ের করা হয়েছে। যদিও ওই সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে ৪২৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনিষ্পন্ন মামলা ছিলো ৯৫,৪৫৫টি।
সভায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, সরকারি অফিসগুলোতে যে সকল কর্মকর্তা বা কর্মচারি আইন শাখায় কাজ করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আইন বিষয়ে ততটা দক্ষ থাকেন না।
অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকারের পক্ষে নিষ্পত্তি হওয়া আদেশও অনেক সময় আইন বিভাগের কর্মীরা বুঝতে পারেন না। যে কারণে অপ্রয়োজনীয় আপিল হচ্ছে।
এ রকম বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, কোনো মামলায় গাফিলতি বা দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে সরকার যাতে মামলায় হেরে না যায়– সেজন্য সংশ্লিষ্ট অফিস, সলিসিটর অনুবিভাগ ও আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগ জানিয়েছে, মামলার জবাব মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে আসে– সেই অবস্থায় আটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সলিসিটর বিভাগ কোনো মামলার জবাব পুনরায় লিপিবদ্ধ করে না।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেসব মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে যাবে, সেগুলো সময়মত আপিল দায়ের করতে হবে।
সলিসিটর বিভাগ থেকে এর আগে কোনো মামলায় কী ধরনের কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করতে হবে– সে বিষয় উল্লেখ করে সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
এছাড়া, কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে– একই বিষয়ে দায়ের করা মামলার শুনানি একত্রে করা হবে। এজন্য সকল মন্ত্রণালয় থেকে একই ধরনের মামলার তথ্য আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর অনুবিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগে নীতিমালা
ব্যাপক মামলা জট ও মামলায় হেরে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি মামলা পরিচালনার জন্য বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ ও বেসরকারি আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই কমিটি।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি করেছে। আগামী সভার আগে নীতিমালার খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে।
পাশাপাশি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালস অ্যাক্ট ১৯৮০ সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ আইন সংশোধনের মাধ্যমে মামলা তামাদির সময় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ আইনের বিভিন্ন ধারায় বিষয়বস্তু ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তামাদির সময় ৭ দিন থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বলা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বছর থেকে তিন বছর পর্যন্ত সীমিত।
উচ্চ আদালতে সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চলমান মামলার তথ্যভাণ্ডার তৈরি
উচ্চ আদালতে সরকারের চলমান মামলার তথ্য সংরক্ষণ, মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যক্রম দক্ষতা ও গতিশীলতার সাথে সম্পাদনের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে 'স্মার্ট কেইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এ সিস্টেম ব্যবহার করবে।
ইতোমেধ্যে ৫৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, ৬৪ জেলা প্রশাসক অফিস, ১২৪০টি দপ্তর ও সংস্থার ই-নথি বা ডি-নথির সাথে ইন্টিগ্রেশন হয়েছে।
এখন মামলার তথ্য সিস্টেমে আপলোড করা ও ডেটা এন্ট্রি করার কাজ শুরু হয়েছে। মামলার তথ্য সময়মত আপলোড করার ওপর এই সিস্টেমের সফলতা নির্ভর করছে।
একটি মামলার প্রায় ২০ ধরনের তথ্য সিস্টেমে এন্ট্রি ও ডকুমেন্ট সংযুক্ত করতে হয়, যা বেশ টেকনিক্যাল ও শ্রমসাধ্য কাজ। দ্রুততম সময়ে কাজটি করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সরকার জড়িত, এমন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে সরকার জড়িত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।"
তিনি বলেন, "আশা করা যায়– নতুন এই উদ্যোগ সরকার সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে সন্তোষজনক অগ্রগতি আনবে।"