এসএমই মেলায় ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি পোশাক ও গৃহস্থালী পণ্যে
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চলমান ১১তম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) পণ্য মেলায় ক্রেতাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে পোশাক ও গৃহস্থালী পণ্য। গত ১৯ মে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে আগামী ২৫ মে পর্যন্ত।
এসএমই মেলার দ্বিতীয় দিন ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় দেশি পণ্যের সমাহার অনেক বেশি, যা ক্রেতাদেরকে আকৃষ্ট করছে। ফলে মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা কিছু না কিছু পণ্য কিনছেনই।
তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য, হস্ত ও কারু শিল্প, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, খাদ্যপণ্য, তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা, জুয়েলারি, প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স খাত, ফার্নিচার খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরের পণ্য কিনতে পাওয়া যাচ্ছে মেলায়।
আনিসুর রহমান মেলায় এসেছেন স্ত্রীকে নিয়ে। তিনি শতরঞ্জি, শাড়ি ও ঘর সাজানো পাটের কিছু সামগ্রী কিনেছেন।
আনিসুর রহমান বলেন, "এখানে আসলে উদ্যেক্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়। তাই উপর পণ্যের মান ভালো। আমরা নিশ্চিন্তে দেশি পণ্য কিনতে পারি।"
"অনেক পণ্য থাকায় মেলায় আসলে কিছু না কিছু কেনাই হয়। এখানে যেমন ৫০ টাকা দামের পণ্য থাকে, তেমনি ১৫ হাজার টাকা দামেরও পণ্য পাওয়া যায়," বলেন তিনি।
মেলায় তৈরি পোশাক শিল্পের স্টল সবচেয়ে বেশি। মোট ৭৫টি কোম্পানি অংশ নিয়েছে এবারের মেলায়।
নারী উদ্যোক্তা ফোরাম প্রায় ২,০০০ জন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে। মেলায় তাদের স্টলে দেখা গেছে বাহারী পোশাক, থেকে শুরু করে ঘর সাজানো পণ্য।
নারী উদ্যোক্তা ফোরামের সভাপতি রাফিয়া আক্তার বলেন, "মেলাতে আমাদের পণ্যের চাহিদা ভালো। তবে এ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেন রপ্তানি করতে পারে, সেই দিকে সরকারকারে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন প্রদির্শনীতে তাদের পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।"
জাহানারা বেগম মেলা থেকে বিছানার চাদর কিনেছেন। তিনি বলেন, "এখানে অনেক ধরনের ডিজাইন থেকে বেছে চাদর কেনা যায়। আর দামেও বেশ সাশ্রয়ী।"
রংপুর ক্রাফটের সিইও স্বপ্না রানী সেন বলেন, "২০১১ সাল থেকে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি তৈরি করছি। এবারের মেলায় টেবিল রানার সেট, ফ্লোর ম্যাটের চাহিদা ভালো।"
পটুয়াখালীর বাউল থেকে মৃৎশিল্পের পণ্য নিয়ে এসেছে উদ্যেক্তারা। স্টলের বিক্রিয় কর্মী মোহম্মদ রবিউল বলেন, "মাটির ডিনার সামগ্রির চাহিদা বেশি। এ ধরনের মেলায় আমরা আমাদের পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে পারি। ক্রেতারা জানছেন মাটি দিয়ে এখন শুধু কলস, পাতিলই তৈরি হয় না। ডিনার সেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন শোপিসও তৈরি হচ্ছে।"
পাটের বহুমুখী পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠান তুলিকা অংশ নিয়েছে মেলায়। এর স্টলে রয়েছে পাটের তৈরি ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, ওয়াই ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, হ্যান্ডিক্রাফট, হোম ডেকরসহ নান্দনিক শিকে।
তুলিকার সিইও ইসরাত জাহান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, যাদের পণ্যের গুণগতমান ভালো এবং আকর্ষণীয়– তারা খুব সহজেই সাধারণ ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন এই মেলার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, "তবে, মেলার মাধ্যমে দেশীয় পণ্য দেশের বাজারে, দেশের মানুষের কাছে প্রচার এবং প্রসারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারের জন্যেও কীভাবে এর প্রচার বাড়ানো যায়— এই নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।"
ইসরাত জাহান আরও বলেন, "বাংলাদেশে নিযুক্ত যত অ্যাম্বাসি আছে, তাদেরকে মেলায় আমন্ত্রণ করে পণ্য ঘুরে দেখানো এবং কীভাবে সম্ভাবনাময় পণ্যগুলোকে সেসব দেশে বাজারজাত করা যায়– সে বিষয়ে এই এসএমই মেলার মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।"
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক খাবারের স্টলও রয়েছে। যেখানে হরেক করমের পিঠাসহ মুখরোচক খাবার বিক্রি হচ্ছে। রয়েছে বাচ্চাদের জন্য শিক্ষামূলক বই।
নিজেদের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এখানকার উদ্যোক্তারা।
চামড়াজাত পণ্যের স্টলের মালিক রুবিনা আক্তার মুন্নি বলেন, "আমি পণ্য ক্ষুদ্র আকারে রপ্তানি করছি কয়েক বছর ধরে। তবে বড় আকারে পণ্য রপ্তানি জন্য বায়ারা এখন দেখতে চাচ্ছে কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি। আমাদের মত ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের এমন ফ্যাক্টরি তৈরিতে সরকারে নীতি সহায়তা প্রয়োজন।"
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মাসুদুর রহমান জানান, মেলায় ৩৫০ জনেরও বেশি উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী। তিনি মেলার সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন– আগের এসএমই মেলায় ৪২ কোটি টাকার ওপরে পণ্য বেশি বিক্রির পাশাপাশি ৭২ কোটি টাকারও বেশি পণ্যের অর্ডার গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের জন্য স্মার্ট ফিন্যান্সিং
এদিকে এসএমই ফাউন্ডেশনের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে 'স্মার্ট ফাইন্যান্সিং ফর স্মার্ট বাংলাদেশ: সলিউশন ফর মার্জিনাল এন্টারপ্রেনারস'— শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জায়তুন বিজনেস সলিউশনের চেয়ারম্যান আরফান আলী।
এ সময় তিনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে অটো ক্রেডিট স্কোরিং ব্যবহার করে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
ব্যবসায় অগ্রগতি সত্ত্বেও, অনেক ক্ষুদ্র-উদ্যোক্তা এখনও তাদের আর্থিক রেকর্ডের অভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএসএমই-এর জন্য অর্থনৈতিক শিক্ষার গুরুত্বের উপরেও জোর দিয়েছেন। ব্যবসায় স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করতে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবারগুলোর সুবিধাও তুলে ধরেন তিনি।
সেমিনার চলাকালে প্রায় দশজন কর্মী এমএসএমই এর উন্নয়নে সহজ অর্থায়ন ব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন। তারা কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত সমস্যা, অর্থায়নের বিকল্পের অভাব এবং আইনি নথিপত্রের অভাবে ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন।
এ সময় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসেকা আয়েশা খান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনে যথাযথ আর্থিক রেকর্ড বজায় রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন। আর এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে তিনি ডিজিটাল অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমের ওপর গুরুত্ব দেন।