কীভাবে একটি ‘রুগ্ন’ ব্যাংককে বাঁচানো যায়, উদাহরণ তৈরি করেছে সিটি ব্যাংক
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন নানাবিধ চ্যালেঞ্জে জর্জরিত হচ্ছিল সিটি ব্যাংক। খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলা, প্রভিশন ঘাটতি থেকে শুরু করে শেয়ার থেকে সামান্য আয় তো হচ্ছিলই, সাথে ছিল আমানত ও ঋণের ক্ষীণ প্রবৃদ্ধি। এসব সমস্যায় ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, ২০০৬-০৭ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তাকে সিটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠাতে হয়।
সেখান থেকে ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার হয়েছে অসামান্য উন্নতি। আজ যে কাউকে দেশের শীর্ষ তিনটি ব্যাংকের নাম জিজ্ঞেস করলে, নিঃসন্দেহে প্রায় সবার দেওয়া তালিকাতেই থাকবে সিটি ব্যাংকের নাম। কিন্তু কোন উপায়ে হলো এই জাদুকরি রূপান্তর; যার দৌলতে সমস্যাক্লিষ্ট ব্যবসায়িক সত্ত্বা থেকে শুধু দাঁড়ানোই নয়, একইসঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কাতারে উঠে এলো সিটি ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের যে অংশ খেলাপি হয়ে যায়– তার বিপরীতে নিদৃষ্ট হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। এসব প্রভিশন করতে হয় মুনাফা থেকে। ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকের প্রভিশন কাভারেজের হার ছিল মাত্র ৬০ শতাংশ। গত বছরের শেষে যা ১১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই ঘটনা সিটি ব্যাংকের দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সাক্ষীই দিচ্ছে। একইভাবে ২০১৫ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭.৬ শতাংশ থাকলেও– ২০২৩ সালে সেটি নেমে এসেছে মাত্র ৩.৬ শতাংশে। এতে ব্যাংকের সম্পদের মান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার ইঙ্গিত মিলেছে।
আর্থিক অবস্থানের এক মুল্যায়নে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকে মোট আমানত ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। ১৫ বছর পরে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ, আর ঋণ বেড়েছে ১৫ গুণ। আর্থিক এই প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকদের বর্ধিত আস্থাই প্রমাণ করে এসব তথ্য।
প্রদত্ত সুদ থেকে ব্যাংকের সুদ বাবদ আয় বাদ দিলে যা থাকে, সেটিই হচ্ছে ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত সুদ আয়। এতেও হয়েছে অবিশ্বাস্য উত্থান। ২০০৭ সালে প্রকৃত সুদ আয় যেখানে ছিল মাত্র ৯৫ কোটি টাকা, তা ২০২৩ সালে এক হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এছাড়া, মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত, তারল্য অনুপাত, শেয়ারহোল্ডারদের প্রদত্ত রিটার্নের পাশাপাশি সার্বিক আমানতের মধ্যে চলতি ও সঞ্চয়ী (স্বল্প-খরচের) আমানতের অংশও বেড়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যখন দূরবস্থার কথাই বেশি আলোচনা হয়, তখন সেটি ব্যাংক যেন এক আলোকবর্তিকা, যা অন্যদের একইভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাচ্ছে।
কিন্তু, সাফল্যগাঁথা আরো রয়েছে। সিটি ব্যাংক শুধু প্রচলিত ব্যাংকিংয়েই অসাধারণ পারদর্শিতা দেখায়নি, ক্রেডিট কার্ড সেগমেন্টেও ২৫ শতাংশ বাজার অংশীদারত্ব নিয়ে আধিপত্য করছে। দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৩ হাজার পিওএস মেশিন নিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে দারুণ এক উত্থানের পথে সিটি ব্যাংক। কেবল ২০২৩ সালেই এ ব্যাংকের গ্রাহকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে সিটি ব্যাংক। ২০২৩ সালে দেশের ১৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি লেনদেনের ৬ শতাংশের মতো উল্লেখযোগ্য অংশ হয়েছে সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে। এছাড়া, দেশের ২২ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অর্থায়ন লাভের সুবিধা দিয়েছে। ব্যাংকটির প্রবৃদ্ধি এতই অসামান্য হয়েছে যে, ২০২৩ সালে কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য ভাতা বাবদ ৮০০ কোটি টাকা দিয়েছে। ব্যাংকের ২০২০ সালের প্রকৃত সুদ আয়ের কাছাকাছি ছিল এই অঙ্ক।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন পর্যবেক্ষককে সিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, 'ব্যালেন্সশিট পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে আমরা এই রূপান্তরের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এরপর আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে বোর্ডের থেকে কোনোরকম হস্তক্ষেপ না আসা, ঋণ ও আমানত বহুমুখীকরণ এবং ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ এই রুপান্তরের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে।
দেশের ব্যাংকগুলোর স্থিতিপত্রে বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক ঋণের পরিমাণ সাধারণত বেশি হয়ে থাকে, যা তাদের মোট পোর্টফলিও'র ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। আর এখানেই অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম সিটি ব্যাংক, তাঁদের স্থিতিপত্রের ৫০ শতাংশই এখন নন-কর্পোরেট ঋণ। আর এই পদক্ষেপ ভালো রিটার্নই দিচ্ছে, ২০২৩ সালে ব্যাংকের ৪০ শতাংশ আয়ই হয়েছে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রিটেইল সেগমেন্ট থেকে।
আরেফিন মাসরুর বলেন, ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য আয়ের (ডিসপোজেবল ইনকাম) পরিমাণও বাড়ছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই ব্যক্তিগত ও রিটেইল ঋণের পোর্টফলিও বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে সিটি ব্যাংক।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক এসব ঋণের মধ্যে রয়েছে রিটেইল, ক্রেডিট কার্ড, অটো এবং হোম লোন। পার্সোনাল লোন বিভিন্ন ধরনেরও হয়; চিকিৎসা ব্যয় থেকে শুরু করে – বাড়ি সংস্কার বা বিয়ের অনুষ্ঠানের অর্থায়নের মতো নানাবিধ প্রয়োজনে ব্যক্তিগত ঋণ নেয় গ্রাহক।
২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল ছিল সিটি ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়
২০০৮ সালে নিজস্ব ভাবমূর্তি ও সেবার এক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে সিটি ব্যাংক। এসব রুপান্তরের মধ্যে ছিল ব্যাংকের নতুন লোগোর প্রবর্তন, আমেরিকান এক্সপ্রেসের ক্রেডিট কার্ড চালু এবং ব্রোকারেজ ব্যবসা স্থাপন।
এরপর ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের একটি সংস্থা– ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) ৫ শতাংশ শেয়ার কিনে সিটি ব্যাংকের একক বৃহত্তম অংশীদার হয়। মালিকানায় আইএফসির অন্তর্ভুক্তি কর্পোরেট সুশাসন চর্চা এবং বিধিমালা প্রতিপালনকে উৎসাহিত করতে অপরিহার্য অবদান রাখে।
রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা রাখেন যারা
সিটি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ২০০৮ সালেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। রুপান্তরের এই যাত্রায় তিনি রাখেন নেতৃত্বমূলক ভূমিকা। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) এর সফল রুপান্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্যাংকখাতে সুপরিচিত মোহাম্মদ সাত্তারকে ২০০৭ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে তিনিই আনেন সিটি ব্যাংকে। সাত্তারকে পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে তাঁকে সিটি ব্যাংকের আমূল সংস্কারের সুযোগ করে দেন কায়সার। ওই সময়ে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকা সিটি ব্যাংকের জন্য একেবারেই জরুরী পড়েছিল।
সেসব দিনের কথা আজো মনে আছে সাত্তারের। তিনি বলেন, "ওই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে একটি ফটোকপি মেশিন কেনার অবস্থাও ছিল না আমাদের। ঋণ প্রদানেও ছিল বিধিনিষেধ।"
ওই অবস্থা থেকে ব্যাংকটিকে উত্তরণের জন্য তিনি ১০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এর ছয় মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সমস্যাকবলিত ব্যাংকের ক্যাটাগরি থেকে এক ধাপ উন্নতি হয় সিটি ব্যাংকের। অর্থাৎ, বিধিনিষেধের কড়াকড়ি তখন কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উঠে আসে আগাম নজরদারির শ্রেণিতে।
সাত্তার জানান, আরো দেড় বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে সিটি ব্যাংক একটি স্বাভাবিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ফিরে পায়।
এরপরে তথ্যপ্রযুক্তি, ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ঋণ প্রদান – প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ধারাবাহিক সংস্কার শুরু করেন তিনি।
সাত্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০০৮ সালে অ্যামেক্স কার্ডের অধিগ্রহণ সিটি ব্যাংকের ব্রান্ডিংকে অনেকটাই শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখে। আইএফসির সিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদভুক্ত হওয়ার ঘটনাও ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তাঁর মতে, এনিয়ে ২০১০ সালে আইএফসির সাথে আলোচনা শুরু হয়, আর ২০১৩ সালের মধ্যে শেয়ারমূল্য নির্ধারণসহ নানান বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়।
"এখন সিটি ব্যাংক এসব সংস্কারের সুফল পাচ্ছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রিটেইল খাত থেকে আসছে মুনাফার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ"- যোগ করেন তিনি।