সুইসুতোয় লেখার আমার সেলাইখাতা
হাতে লেখা গল্পের মতো সেলাইও কত কথাই না বলে! পুরুষের ঐ শিকারী-যোদ্ধা-বীর-রাজার রাজত্বকে মেয়েদের বাচাল- অনুভূতিময়- অভিব্যক্তিতে ঠাসা হাত কেমন করে অনুবাদ করে নেয়! বহুকাল আগে একটা গান শুনেছিলাম 'গহীন রাইতে বাত্তি জ্বাইলা সিলাই নকশী খেতা'...কেমন হাহাকারের মতো একটানা সুর। বাতির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন টকটকে চোখের তরতরে হাতের সেই মেয়েদের গান, যারা স্রষ্টার মতো অন্তরালে থেকে যেত। ফরাসী ট্যাপেস্ট্রি থেকে বাঙালির নকশীকাঁথা অব্দি যারা কেবল পুরুষের বীরগাঁথাই লিখতো সুইয়ে বিঁধিয়ে, নিজেরা রয়ে যেত অন্ধকারে, নিশ্চুপ।
এ লেখার বিষয় সেলাইখাতা। সেলাইয়ের প্যাটার্ন লিখে রাখবার খাতা, রেসিপি টুকে রাখবার খাতা, গানের লিরিক শুনে শুনে লিখে রাখা খাতা—এসব খাতার সাথে আমাদের অনেককালের যোগাযোগ, অনেকদিনের দুপুরবেলাকার বিরল অবকাশে মেলে দেখবার সাথী এরা, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম হস্তান্তরিত হবার উত্তরাধিকার। কিন্তু এই নিয়ে লিখবার আগে একটু আমড়াগাছি করতে চাই।
বছর ছয়েক আগের কথা, কাম্ব্রিয়ান রাস্কিন মিউজিয়ামে গেছি। ইনি হচ্ছেন সেই জন রাস্কিন যার বাণী বিটিভিতে দেখানো হতো আর আমরা রচনায় উদ্ধৃতি দিতাম। যে যূথভ্রষ্ট শিল্পীদের 'আধুনিক উন্মাদ' বলা হতো তাদের নিয়ে এই রাস্কিন লিখেছিলেন 'মডার্ন পেইন্টার্স'এর মতো পাঁচ ভল্যুমের আর্ট-হিস্ট্রি। সেখানে টার্নারকে নিয়ে বিশাল প্রবন্ধ আছে, র্যাফায়েলের পরে জন্মে যারা নিজেদের 'প্রির্যাফায়ালাইট' দাবী করেছিলেন তাদের নিয়ে কাজ আছে।
ওয়াপিং-এর খালাসিদের অখ্যাত ঠেক আর বে-পাড়ায় সারা উইকেন্ড কাটিয়ে টার্নার (ইনি ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্টদের কাছে ঈশ্বরতূল্য) ফিরে আসতেন অজস্র স্কেচ করে, মানবশরীর আর মানবপ্রবৃত্তির যত অলিগলি আছে আর যত নমুনা আছে, তার সবক'টির চিত্রিত ইতিহাস সে'সব স্কেচ। এইসব ড্রয়িং রাস্কিনের হাতে পড়েছিল, গুরুস্থানীয় টার্নারের এমন অধঃপতনের ইতিবৃত্ত...স্কেচগুলো রাস্কিন নষ্ট করে ফেলেছিলেন। তা রাস্কিন মিউজিয়ামে ঢুকবার সময় এ-সব আমার মাথায় বুদ্বুদের মতো ফুটছে, বাঘা বাঘা শিল্পীদের নিয়ে যিনি শিল্পসমালোচনা লিখতেন তাঁর মিউজিয়ামে ঢুকছি!
অবাক হয়ে একপর্যায়ে দেখি রাস্কিন মিউজিয়ামে 'লিনেন অ্যান্ড লেস' নামে একটা সংরক্ষণশালা আছে, সেখানে বিশাল বিশাল ক্যাবিনেটে সংরক্ষিত আছে অসংখ্য শতবর্ষীয় লেসের কাজ, রাস্কিনের অনুপ্রেরণায় এই লেস তৈরির কুটিরশিল্প বিকশিত হয়েছিল। চিন্তকদের দুনিয়া থেকে 'মেয়েলি'-দুনিয়া অনেক দূরের ভেবেছিলেন তো? রাস্কিন দেখিয়ে গেছেন—ঐ জগত আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের আকর, ঐ দুনিয়া শিল্পনিদর্শন সৃষ্টির মাতৃকা। দেখিয়ে গেছেন শিল্পের পৃথিবীতে সেকালের নারী-পুরুষের দুনিয়া পরস্পরসাপেক্ষ।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা কেউ কেউ সারাজীবন কেবল ঘরকন্না করেছেন, কেউ লিখে গেছেন ঘরকন্নার- ভোজনপদ্ধতির এবং রান্নার ইতিহাস। প্রজ্ঞাসুন্দরী এবং পূর্ণিমা ঠাকুরের বই এখনো রান্নার বই হিসেবে পরম-সমাদৃত। ইন্দিরা দেবী রান্নাঘরে যেতেন না, অথচ বহু রেসিপি তিনি লিখে রেখে গেছেন। আজ দুশো বছর পর দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই, সেই রান্নার বইগুলো মানুষের বিকাশমানতার ইতিহাসে পরিণত হয়েছে, সামাজিক ইতিহাসের এমন অ্যালবামে পরিণত হয়েছে যা থেকে টুকে নাটক-সিনেমা করা যায়, যা ভাঙিয়ে জোটে যুগান্তরের ইতিহাসের শস্যকণা। 'নারীর উক্তি' বইটিতে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লিখেছিলেন, "সমাজ সংস্কার করিতে গেলেই পুরাতন মন্দের সহিত কতক ভালোও লোপ পায়, এবং নূতন ভালোর সহিত মন্দও আসিয়া পড়ে।" এই সেলাইখাতাও সেই লোপ পাওয়া 'পুরাতন-ভালো'। সে ইতিহাস। সে কালের চিহ্ন।
রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি'র বিধবা বিনোদিনী দাসী কতই না রেশমের কাজ করতো বালিশে, 'নষ্টনীড়'এর চারুবালা রেশমলতার কাজ বুনতো এমনকি মশারিতে, আসন বুনতো আর কার্পেটের চটি বুনতো...কেমন হতে পারতো তাদের সেলাই খাতা? রবীন্দ্রনাথের 'স্ত্রীর পত্র'র মৃণালেরও কি সেলাইখাতা ছিল? মৃণাল তো বলেছিল—তার স্বামীর সংসারের ওপরটা রেশমসেলাইয়ের ওপরের দিকটার মতো মসৃণ আর উজ্জ্বল, অন্তঃপুর রেশমসেলাইয়ের পেছনটুকুর মতোই, গেরো দিয়ে ভরা, অপরিচ্ছন্ন, অপরিপাটি। সেলাই না জানলে কি আর অমন দুর্দান্ত উপমা দেয়া সম্ভব? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনস্মৃতি লিখতে গিয়ে তাঁর ছোটপিসির গল্প করেছিলেন— 'বাবামশায় ছোটোপিসিকে সাহেব-বাড়ি থেকে সেলাইয়ের বই, রেশম কত কী এনে দিতেন আর তিনি বই দেখে দেখে নতুন নতুন সেলাইয়ের নমুনা নিয়ে কত কী কাজ করতেন তার ঠিক নেই! ছোটোপিসি এক জোড়া ছোট্ট বালা পুঁতি গেঁথে গেঁথে গড়েছিলেন—সোনালি পুঁতির উপরে ফিরোজার ফুল বসানো ছোট্ট বালা দু'গাছি, সোনার বালার চেয়েও ঢের সুন্দর দেখতে।'
ইন্দিরা দেবী লিখেছিলেন—স্ত্রীশিক্ষার প্রকোপে 'বড়ি দিবার আর পান সাজিবার অবকাশ'ই নেই মেয়েদের, তারা নাকে-মুখে চাট্টি ভাত গুঁজে ইস্কুলে দৌড়োয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে— এই সেলাই খাতাগুলো কিন্তু বিমল মিত্রের অন্তঃপুরচারিনী পট্টেশ্বরী বৌঠানের ('সাহেব বিবি গোলাম' উপন্যাস) নয়, বরং শুরুর দিকের সেইসব মেয়েদের, যারা ইস্কুলে দৌড়োবার সুযোগ পেয়েছিল, তবু সুকুমারবৃত্তির ছোঁয়া যাদের জীবনে বজায় ছিল, ক্র্যাফটের হাত ধরে। জিন্দাবাহারের দর্জি-খলিফার হাতের মিহি সেলাই নয়, দুপুরের অবকাশে ফুটিয়ে তোলা একগোছা লালসুতোর রঙ্গন—বালিশে কিংবা টেবিলক্লথে। হাতে একটা বোনার কাজ কিংবা নভেল, এইই ছিল সেকালের দুপুরে দিবানিদ্রার বিকল্প। বিলেতে এমন সেলাইয়ে নিমগ্নতা নিয়ে ঠাট্টা করে বলা হতো—রাজারাজড়াদের জন্যে ব্যসন-বিলাস আর বাকি সাধারণদের জন্যে শুধু মুখ বুঁজে সেলাই আর আজ্ঞানুবর্তিতা (ওবিডিয়েন্স)। তা উইলিয়াম দ্য কঙ্কারারের আমল থেকেই বিলিতি এমব্রয়ডারির নাম সুবিদিত।
অবনীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন 'ঠুনকো রাজত্ব', আমাদের বাড়িতে সেই রাজত্ব ছিল আম্মার সেলাইকলটাকে ঘিরে। সেলাইমেশিনের গায়ে সোনালি লতাপাতা, মেশিনের কালো চটচটে গায়ের গড়নে শঙ্খিনী কন্যার গায়ের মতো ঢেউ আর বড় বড় সোনালি অক্ষরে নাম লেখা 'সিঙ্গার'। মেশিনের পেটে অন্দরমহল আছে, সেলাইমেশিনের সখীও আছে, বিলাতি বিস্কুটের টিনে বোঝাই রেশমসুতোর গোছা, পুঁতি, হরেক রঙের বোতাম। আর এই রাজত্বের সংবিধান ছিল সেলাইখাতাটা। পেটিকোটে ছোট ছোট চোখের মতো করে কাটা আইলেটস আর তার চারদিকে বোতামঘর সেলাই, ব্লাউজের হাতার লেস, উলের ব্লাউজ, ফ্রকের বুকে হনিকম্ব কাজ, লেসের কাজ করা সেমিজ, এইসব কত কী করা হতো একসময়। রম্পার্স, ড্রয়ার্স, ব্লুমার্স অর্থাৎ সেলাই করা প্যান্টুলও ছিল তখন, ফ্রকের সাথে মিলিয়ে একই ছাপার।
আমাদের বাড়িতে সেলাইখাতা ছিল আমার দাদীর, ফুপুর, কাটিং আর প্যাটার্ন জমানোর শখ ছিল আম্মা এবং খালাদের, খাতার ভেতর ছোট ছোট চৌকো কাপড়ে তুলে রাখা থাকতো সুইয়ের রকমারি ফোঁড়—'ফ্রেঞ্চ নট' দিয়ে ফুল, 'লেজি-ডেজি' দিয়ে ঘাসফুল, বেণীফোঁড় বা চেইন স্টিচ দিয়ে পাতা আর শাখা, আর থাকতো গায়ের মাপ। চোখের জোর থাকতে বাড়ির মেয়েরাই শালকরদের মতো মিহি করে ছেঁড়া কাপড় রিপু করতে পারতো, বিবর্ণ শাড়ির পাড় ছিঁড়ে ফিতে করতো বা সিলিয়ে নিত অন্য শাড়িতে, ফাটা কলার উলটে সেলাই করে দিত, কলারে বকরম ঢুকিয়ে ইস্ত্রি করতো...সেসব মেরামতের পদ্ধতি সেলাইখাতায় থাকতো না। শীতকালের কার্ডিগ্যান বোনার প্যাটার্ন, কুরুশকাঁটার কাজ, ক্রসস্টিচের প্যাটার্নে কি করে ফুলদানিভরা ফুল কিংবা বিলাতি বাংলোবাড়ি এইসব তোলা যায় কাপড়ে এইসব লেখা থাকতো।
বিটি পাস করবার সময় অ্যাংলো মেয়েদের সাথে উলের কাজ, সুতোর কাজ, কুরুশকাঁটার কাজ শিখেছিল আমার দাদী, শোলার পাখি তুলোর পাখি রঙ করা পাখি বানাতে জানতো, উল বুনবার ক্লাসে খ্রীস্টান মেয়েরা পেত শাদা উল (বড় পরিচ্ছন্ন ছিল তারা) আর বাকিরা (আমার দাদীসহ মুসলমান বা হিন্দুঘরের মেয়েরা) পেত রঙিন উল, বুনবার সময় ময়লা করে ফেলতো বলে। এসবই আমার শোনা গল্প। আমার মনে আছে আমি নানীদের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো এমব্রয়ডারি (কশিদা কাজ) দেখেছি, তাতে লেখা—'অকূল পাথারে খোদা তুমিই ভরসা মম', কিংবা 'শিশিরে কি ভিজে বন বিনা বরিষণে, চিঠিতে কি ভিজে মন বিনা দরিশনে'। সেলাইফোঁড়াই নিয়ে একটা বাগধারা রয়েছে বাংলায়, যা আমার মতো কুনো লোকের জন্যই বলা—ঐ যে 'সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়'। সেলাইখাতা রাখবার বিদ্যা নেই আমাদের গফরগাঁওয়ের বুয়ার, তাকে কেউ লিখে দিত হরফ আর সে সুই চালিয়ে লিখতো প্রাণের আকুতি 'হাতেতে রাখিও রুমাল পুঁছিও মুখের ঘাম, জনমের তরে লিখিয়া রাখিও আমাগের নাম', এই 'আমাগের' শব্দটা আমার মনে সাঁই করে বিঁধে গেছিল মনে আছে, জনমের তরে কে বা কার যূগল নাম লিখে রাখে!
বুয়া কি আর জানে, 'নকশীকাঁথার মাঠ'-এর সাজু কেমন করে মনের যাতনা লিখে গেছিল কাঁথাফোঁড়ে? কেমন করে রাণী পেনেলোপি রাজা অডিসিউস ফিরে আসবার অপেক্ষায় দিনভর বুনেছিলেন সুজনি আর রাতে খুলে ফেলতেন সেই কাজ, কেমন করে হারকিউলিসের স্ত্রী ডায়ানেরা স্বামী পরনারীতে আসক্ত সন্দেহে হারকিউলিসের মতি ফেরাতে মৃত সেন্টরের বিষাক্ত রক্তে ভিজিয়ে আংরাখা পরিয়েছিলেন...কেমন করে নেপোলিয়নের হাতে আসা ফরাসী ট্যাপেস্ট্রিতে আঁকা হয়ে রইলো অপয়া হ্যালির ধুমকেতু, পরে হিটলারের এসএস বাহিনীর প্রধান হিমলার এই ট্যাপেস্ট্রি জার্মানিতে পাচার করার ফিকির করেছিলেন। হাতে লেখা গল্পের মতো সেলাইও কত কথাই না বলে! পুরুষের ঐ শিকারী-যোদ্ধা-বীর-রাজার রাজত্বকে মেয়েদের বাচাল- অনুভূতিময়- অভিব্যক্তিতে ঠাসা হাত কেমন করে অনুবাদ করে নেয়! বহুকাল আগে একটা গান শুনেছিলাম কাঁথাসিলানি মেয়েদের গান, শুরুর লাইনটা বোধহয় 'গহীন রাইতে বাত্তি জ্বাইলা সিলাই নকশী খেতা'...কেমন হাহাকারের মতো একটানা সুর। বাতির ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন টকটকে চোখের তরতরে হাতের সেই মেয়েদের গান, যারা স্রষ্টার মতো অন্তরালে থেকে যেত। ফরাসী ট্যাপেস্ট্রি থেকে বাঙালির নকশীকাঁথা অব্দি যারা কেবল পুরুষের বীরগাঁথাই লিখতো সুইয়ে বিঁধিয়ে, নিজেরা রয়ে যেত অন্ধকারে, নিশ্চুপ।
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম! আমি তো সেলাইয়ের খাতা নিয়ে লিখব, ব্যবহারে জীর্ণ খাতা, মলাট ছিন্ন, ভেতরে ঘরকন্নার তেলহলুদের চিহ্নও থাকতে পারে, বিশীর্ণ একটা ঝাউপাতা কিংবা ফুল কি থাকতে পারে? নাকি শুধুই কেজো খাতা সেটা? শুধুই শীতের হাতমোজা, মোজা, বাচ্চাদের সোয়েটার, বাঁদরটুপি, কাঁথা? ঘর পড়ে গেলে কী করে তুলতে হয় সেসব? গলা ভি-গলা নাকি গোল-গলা? হাতা কেমন? তারপর লিখব এইসব সেলাইখাতা রাখার অভ্যাসগুলো গেল কোথায়। অবকাশের অভাব নাকি প্রাসঙ্গিকতার, নাকি উপযোগবাদিতার সাথে সংবেদনশীলতার যুদ্ধে সংবেদনের পরাজয়? যা কিনতেই পাওয়া যায় তা গড়বার অনীহা? যা কলে তৈরি হলেই সুলভ, তা কি আর কেউ হাতে গড়ে না?
ভিক্টোরিয়ান ড্রেসমেকিং এবং গার্মেন্ট প্যাটার্নের বই আপনি চাইলেই কিনতে পারবেন অনলাইনে, এটসি-তে, অ্যামাজনে, আজো। পেয়ে যাবেন মেরী ফ্রান্সিসের ১৯১৩ সালের সচিত্র সেলাইখাতা— 'সেলাইপাখি' সেখানে শেখাচ্ছেন কী করে পুতুলের জামা বানায়, কেমন করে বানায় পুতুলের বটুয়া, কী করে হেম সেলাই করে মুড়তে হয় কিনারা, বোতামঘর কী করে সেলাই করতে হয়, কী করে বানায় মেয়েদের পিনাফোর আর মর্নিং-ড্রেস, আর পাতায় পাতায় রয়েছে আর্ট-ডেকো স্টাইলের অলঙ্করণ। ঔপন্যাসিক মার্গারিট অ্যাটউডকে 'এলিয়াস গ্রেস' এবং 'দ্য হ্যান্ডমেইডস টেইল' লিখতে গিয়ে সেকালের মিসেস ইসাবেলা বীটনের পঞ্চাশ প্রকারে মাখন তৈরির উপায় পড়তে হয়েছিল, মিলিয়া ড্যাভেনপোর্টের লেখা 'হিস্ট্রি অভ কস্টিউম' পড়ে জানতে হয়েছিল সেকালের লোকে কেমন কাপড় পরতো, কেমন অন্তর্বাস...গাউনের নীচে তারের খাঁচা পরতো নাকি ঘোড়ার বালামচির। কেন এই খাঁচা, কী বন্দী থাকে এই পিঞ্জরে?
মার্গারিট অ্যাটউড নিজেই উত্তর দিচ্ছেন—এ পিঞ্জরে বন্দী থাকে মেয়েদের পা, যেন কিছুতেই বেরোতে না পারে, যেন কিছুতেই অপরাপর পুরুষের পায়ের সাথে পা ঘষতে না পারে, মেয়েরা এমনকি পা শব্দটা অব্দি বলে না! অ্যাটউড পরে বলেছিলেন—যারা এইভাবে জার্নাল কিংবা রান্নার খাতা বা সেলাইখাতা রেখে যায় তারা ভবিষ্যতের সমাজকে বিশাল এক অনুগ্রহ করে যায়, ভবিষ্যতের বাসিন্দারা জানতে পারে সেকালে সত্যিকারের জীবন কেমন ছিল। সিনেমায় কাজে লাগবে, সাহিত্যে তো লাগবেই।
কিন্তু আপনি চাইলেই কি জানতে পারবেন যে 'দোলাই' গায়ে দিত লোকে, সেটা কেমন ছিল? দশ নম্বুরী সুতার দশ হাত লম্বা আড়াই হাত বহরের 'মোট' কেমন করে লোকে পরতো? আষাঢ় ১৩২৯-এর 'প্রবাসী' পত্রিকার একটা লাইন— 'তাঁতিকুল গেল, চরকা বন্ধ হইল, কাপাস চাষ উঠিয়া গেল', এই পুরো প্রক্রিয়াটার আরো কত সাক্ষী থাকতে পারতো! একই পাতায় আছে, সেকালের লোকে জানুসন্ধি অর্থাৎ হাঁটু ঢেকে খাদি পরতো, খাদি পরে গ্রামান্তরে যেত কিন্তু সভায় যেত না। মেয়েদের শাড়ি হাঁটুর নিচে নামতো কিন্তু গোড়ালির খানিকটা ওপরেই শেষ হতো। সেকালের লোকের আরো আরো জার্নাল- আরো চিঠিপত্র- আরো সেলাইখাতা- আরো পাকপ্রণালী যদি সংরক্ষিত হতো, একটা জীবনচর্যা দেখতে পেতাম আমরা। সহজ সেলাইশিক্ষার বিজ্ঞাপন আছে পুরনো 'প্রবাসী'তে, ১৬২ নং বহুবাজার স্ট্রিটের ব্যানার্জ্জি ব্রাদার্স টেইলার্স ও আউটফিটার্স 'গৃহলক্ষী ও কুমারীগণ'কে অভয় দিয়ে জানাচ্ছে, "ইহাতে সর্ব্বপ্রকার ওয়াড়, পর্দ্দা, মশারি, পেনী, ফ্রক, নিকার, সেমিজ, সায়া, জ্যাকেট, ব্লাউস প্রভৃতি গৃহস্থের নিত্যব্যবহার্য্য কাপড় ও জামার ছাঁট কাট ও সেলাই চিত্রের সাহায্যে অতি সহজ ভাষায় বুঝান হইয়াছে। অন্যের সাহায্য ব্যতীত কেবল পড়িয়াই ছাঁট কাট ও সেলাই করিবার এবং শিখিবার ইহাই একমাত্র পুস্তক।" কেমন, বলুন? একটা সময়কে একেবারে দেখা গেল কি না?
শেষ কথা এই, যতই একাল-সেকালে তফাত থাক, আমাদের মনে রাখতেই হবে মেরামত করবার বিদ্যা এবং হাতে তৈরির বিদ্যা আবার প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে আগামীর পৃথিবীতে। কারণ কলকারখানা আর শিল্পোৎপাদন মানেই এখনো মূলতঃ জীবাশ্ম জ্বালানী, যা ফুরিয়ে আসবেই। কিন্তু শুধু সর্বনাশের শংকা থেকে কি আর সেলাইখাতার কাছে ফেরা যায়? 'হ্যান্ডমেইড' শব্দটার একটা সাঙ্ঘাতিক আবেদন তো আছে, এখনো, আলাদা মূল্যও আছে, থাকবেই। ওতে স্পর্শ লেগে আছে, লেগে আছে ভাবনা, আর মন।