চট্টগ্রামে উন্মুক্ত নালা-খাল: কর্তৃপক্ষ আসলে কী করছে?
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর বিল্লা পাড়া এলাকায় ৭ বছরের সাইদুল ইসলাম বাড়ির পাশেই খেলা করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। খেলার সময় শেষবারের মতো তাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে নাসির খাল থেকে পরের দিন রোববার তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
কর্তৃপক্ষের ধারণা, খেলতে খেলতে ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল সাইদুল। কারণ পাশেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ড্রেনেজ প্রকল্পের কাজের জন্য নালার স্ল্যাবগুলো সরানো হয়েছিল।
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "এলাকাটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। আমরা স্ল্যাবগুলোতে ফাটল খোঁজার কাজ করছিলাম, তাই সেগুলোকে সরিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছিল।"
তিনি দাবি করেন, শিশুটির মরদেহ খোলা নালা থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাওয়া গেছে, সুতরাং তার ওখানে পড়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।
সাইদুল ওই ১১ ভুক্তভোগীর একজন, যারা সম্প্রতি বন্দরনগরীর খোলা নালা বা খালে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
এর আগে, গত ২৭ মে বিকালে নগরীর কোতোয়ালী থানার আছাদগঞ্জ শুটকি পল্লীর কলাবাগিচা খালে পড়ে মৃত্যু হয় আজিজুল হাকিম ইমন নামে ২৭ বছরের এক যুবকের।
এতসব দুর্ঘটনার পরেও এসব মৃত্যুর দায় এড়িয়ে চলেছে সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ; দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে একে অন্যের ঘাড়ে।
তিন বছর আগে এক বৃষ্টির দিনে চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকার মেয়র গলির চশমা খালে পড়ে সিএনজি অটোরিকশা চালক ও যাত্রী দুজনের মৃত্যু হয়েছিল।
এ ঘটনার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে স্থাপন করা হয়নি নিরাপত্তা বেষ্টনী। খালের পাশের সড়ক দিয়ে শিশু-বৃদ্ধসহ স্থানীয় বাসিন্দারা যাতায়াত করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা রবিনুল হক তুহিন সোমবার বিকালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খালের পাশের সড়কে শিশুরা সাইকেল চালায়, ছুটোছুটি করে। বৃষ্টির সময় খালে অনেক স্রোত থাকে। তখন কেউ পড়লে মিনিটের মধ্যে স্রোতে হারিয়ে যাবেন। সড়কটি দিয়ে অটোরিকশা, রিকশা, বাইক যাতায়াত করে। চলাচলকারীদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ।"
চশমা খালের মতো চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ এলাকার নালা বা খালের পাশে নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। ফলে বর্ষা এলেই উন্মুক্ত খাল বা নালাগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ২০২১ সালের অক্টোবরের এক সমীক্ষার তথ্যমতে, নগরীতে ১,১৩৭ কিলোমিটার খাল ও নালা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৯ কিলোমিটার খালের পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫,৫২৭টি স্থানে। নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি খালে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
অথচ ঝুঁকিপূর্ণ খাল-নালার তালিকা প্রণয়নের আড়াই বছর পরও বেষ্টনী দিতে পারেনি সংস্থা দুটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর চকবাজার এলাকার কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে হিজড়া খাল। আবাসিক এলাকাটির নালা ও খালগুলো এখনো অরক্ষিত। বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ওঠে। তখন খাল বা রাস্তা আলাদা করা যায় না।
নগরীর বাদুরতলা জঙ্গিশাহ বাইলেন এলাকায় প্রবাহিত চাক্তাই খালের কাজ চলছে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী।
নগরীর বায়েজিদ থানাধীন শহীদনগর এলাকায় বড় নালাটিরও একই অবস্থা। বাকলিয়ার বগার বিল এলাকায় শান্তিনগর সড়কের পাশে বয়ে যাওয়া চাক্তাই খাল ময়লা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘনবসতি এলাকাটির শিশু-বৃদ্ধরাও অরক্ষিত খালটি পাশ ধরে যাতায়াত করেন।
আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খালে পড়ে গত বছর বর্ষায় শিশুর মৃত্যু হলেও খাল ও নালাগুলো এখনও অরক্ষিত।
নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, চকবাজার, দুই নম্বর গেট, মুন্সিপুকুরপাড়, রহমান নগর, মেয়র গলি, নাসিরাবাদ, আলফালাহ গলি এলাকার নালা ও খাল উন্মুক্ত। জায়গাগুলোতে দেওয়া হয়নি কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী বা রেলিং। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার এসব অরক্ষিত খাল ও বড় নালার পাশ দিয়ে হরহামেশাই যাতায়াত করছে মানুষ।
এদিকে বহাদ্দারহাট মোড় থেকে ষোলশহর পর্যন্ত সিডিএ এভিনিউ সড়কের দুই পাশের খালও উন্মুক্ত। দোকানপাট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে স্ল্যাব দিয়েছে; যা নড়বড়ে।
নগরীর হালিশহরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল আলম তুহিন টিবিএসকে বলেন, "বসুন্ধরার মেয়র গলির রাস্তার মাঝখানের ক্রস নালার স্ল্যাব ভেঙে গেছে একমাস আগে। বৃষ্টি হলেই পানি ওঠে। তখন নালা-সড়ক বোঝার উপায় থাকে না। ঘুর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বৃষ্টির সময় কয়েকটি রিকশা নালার খাদে পড়েছিল। একমাসেও সিটি করপোরেশন স্ল্যাব বসায়নি।"
প্রকল্প গ্রহণের সময় নিরাপত্তা বেষ্টনী আমলে নেওয়া হয়নি
খালে পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় আড়াই বছর আগে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ খাল ও নালার তালিকা তৈরি করে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি চসিক ও সিডিএ।
সিডিএর যুক্ত ছিল, জলাবদ্ধতা প্রকল্পে নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অন্যদিকে চসিক বলছে, সিডিএর ৩৬টি বাদে বাকি খাল ও নালাগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিচ্ছে সংস্থাটি।
তবে চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ নালা ও খালের ১০ শতাংশ এলাকায়ও নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন সংস্থা চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ১৪,৩৮৯ কোটি টাকা ব্যয় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনীয় ব্যয় রাখা হয়নি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক মেগাপ্রকল্প এবং ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার 'কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ' শীর্ষক দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা 'নগরের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন' শীর্ষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চসিক। এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার 'চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন' শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনী ইঞ্জিনিয়ার্স ব্রিগেডের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস টিবিএসকে বলেন, "জলাবদ্ধতা প্রকল্পে নিরাপত্তা বেষ্টিনীর কথা উল্লেখ নেই। খালের কাজ শেষ হলে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের শিডিউলে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরমধ্যে সবকিছুর দাম বেড়েছে। প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করা সম্ভব নয়। তবুও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "শীতলঝর্ণা, চশমা খালসহ উত্তর-পূর্ব দিকের এলাকাগুলোতে পাহাড়ি ঢল নামায় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। এজন্য রেলিং দেওয়া চেষ্টা করছি। এছাড়া চাক্তাই, মির্জা, বীর্জা, মহেশখাল ঘনবসতি এলাকাগুলোও দুর্ঘটনাপ্রবণ। এখনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি। তবে সামনে এসব জায়গায় নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।"
সিডিএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ টিবিএসকে বলেন, "আগের অবস্থা নিয়ে কথা না বলি! আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সকল সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করছি। ঝুঁকিপূর্ণ খাল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করব।"
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শাহীন–উল–ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "খাল বা নালার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর তালিকা করতে প্রকৌশল বিভাগ ও পরিচ্ছন্ন বিভাগের স্ব স্ব জোনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে তালিকা হাতে পাবো। অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার কাজ শুরু হবে।"