এশিয়ার বন্দরগুলোতে জট ও ছুটির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনার সংকট
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।এর ফলে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে বড় প্রভাব পড়ছে।
হেপাগ-লয়েড, মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি, ওশেন নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস, মায়েরস্ক লাইনসহ কয়েকটি মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) এই সংকটে পড়েছে। এ সংকটের কারণ সাম্প্রতিক ঈদের ছুটি, এশিয়ায় বন্দর যানজট, লোহিত সাগরে আক্রমণের কারণে জাহাজগুলোর রুট পরিবর্তন এবং বড় কনটেইনারে রপ্তানি নির্ভরতা।
এ সংকট মোকাবিলায় মেইন লাইন অপারেটরগুলো ভারত, চীন, দুবাই, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪০ ফুট সাইজের খালি কনটেইনার নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে একাধিক ফিডার ভেসেল অপারেটর।
গত তিন দিনে সি কনসোর্টিয়াম তাদের দুটি জাহাজে ৪০ ফুট সাইজের অন্তত ৫০০টি ২০ ফুট সমতুল্য ইউনিটের (টিইইউ_ খালি কনটেইনার নিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। আরও কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পথে রয়েছে।
রপ্তানি পণ্য জাহাজের ওঠার আগে বিভিন্ন বেসরকারি ডিপোতে কনটেইনার বোঝাই করা হয়। সেখান থেকে জাহাজের শিডিউল অনুযায়ী বন্দরে নিয়ে আসা হয়। চট্টগ্রামে ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) এই কার্যক্রম চলে।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন শিকদার বলেন, এই সংকট সবচেয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা রুটে। এর ফলে রপ্তানিকারকেরা চ্যালেঞ্জে পড়ছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে আমদানি হওয়া পণ্যের ৫৫ শতাংশ ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে আসে। বাকি ৪৫ শতাংশ আসে ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারে। একইভাবে ৭০ শতাংশ রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয় ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারে। বাকি ৩০ শতাংশ হয় ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টিইইউ কনটেইনার পণ্য আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে প্রায় ৭ লাখ কনটেইনার পণ্য রপ্তানি হয়। এর ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক পণ্য।
রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে খালি কনটেইনারও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফেরত নেওয়া হয় ট্রান্সশিপমেন্ট হাব বন্দরে।
সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে প্রথমে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং, মালয়েশিয়া, তানজুম পেলাপাস বন্দর হয়ে আনা হচ্ছে এসব কনটেইনার। এরপর সেখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হচ্ছে। এর ফলে শিপিং লাইনগুলোকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সময়ও লাগছে। এতে সাপ্লাই চেইন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সি কনসোর্টিয়ামের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মাইকেল রদ্রিগেজ টিবিএসকে বলেন, তাদের কোম্পানি সম্প্রতি ৫০০ টিইইউ খালি কনটেইনার নিয়ে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ঈদুল আজহার ছুটিতে কনটেইনার ডেলিভারি না হওয়ায় পণ্যভর্তি অনেক কনটেইনার বন্দর এবং ডিপোতে আটকে আছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরে জটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে অনেক আমদানি কনটেইনারও সেখানে আটকে আছে। এসব কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে খালি কনটেইনারের সংকট তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার পরিবহনকারী মায়েরসক লাইনের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে এই মুহূর্তে বড় ধরনের সংকট হচ্ছে আমদানি পণ্যের ডেলিভারি আটকে থাকা। ঈদের ছুটিতে আমদানি কনটেইনার ডেলিভারি না হওয়ায় সেগুলোতে রপ্তানি পণ্য বোঝাই করা যাচ্ছে না। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হলে খালি কনটেইনার সংকট আরও তীব্র হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় পণ্য পরিবহনে এখন ১১ দিন করে মোট ২২ দিন সময় বেশি লাগছে। এর প্রভাবে এই সংকট। শিপিং লাইনগুলোকে বিভিন্ন দেশ থেকে খালি কনটেইনার নিয়ে আসার কারণে এর যে বাড়তি ব্যয় যোগ হচ্ছে সেগুলো সার্বিক ফ্রেইট চার্জের ওপর যোগ হবে।
খালি কনটেইনার সংকটের একটি কারণ লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণ। হুথিদের আক্রমণের কারণে জাহাজগুলোকে কেপ অভ গুড হোপ হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে যাত্রা পথের সময় বেড়েছে এক সপ্তাহ থেকে ৩ সপ্তাহ।
ঘুরপথে জাহাজ চলাচল করার প্রভাবে বিভিন্ন বন্দরে আটকে আছে কনটেইনার। চীনসহ এশিয়া অঞ্চলের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে সময় লাগছে ৫ থেকে ৭ দিন। সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং বন্দরে বাংলাদশের আমদানি পণ্য আটকে আছে। এর প্রভাবে ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনার আটকে গেছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে দেরি হচ্ছে।
একাধিক মেইন লাইন অপারেটর, ফিডার ভেসেল অপারেটর এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এজেন্ট টিবিএসকে জানিয়েছেন,
এছাড়া ঈদুল ফিতরের ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও খালি কনটেইনারের সংকট তৈরী হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে দুটি ঈদের ছুটি এবং একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে অন্তত ২০ দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে জমে যায় কনটেইনার। ফলে জট পরিস্থিতির পাশাপাশি খালি কনটেইনারের সংকট তৈরী হয় বলে জানিয়েছেন শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা।
গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখে টানা পাঁচদিন ছিল সরকারি ছুটি। এই সময়ে বন্দরের কার্যক্রম চালু থাকলেও ঈদের আগে এবং পরে সব মিলিয়ে প্রায় দশ দিন বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারি কার্যক্রম অস্বাভাবিক কমে যায়। ওই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে জমে যায় বড় সংখ্যক কনটেইনার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ঈদের ছুটির সময়ে বন্দর থেকে যেসব আমদানিকারক পণ্য ডেলিভারি নেয়নি, তারা ২৩ জুন থেকে ডেলিভারি নেওয়া শুরু করবে। দু-এক দিনের মধ্যে আমদানি পণ্যের ডেলিভারি কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে।