করোনায় গাজীপুরে রিসোর্ট ব্যবসায় ধস, ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
শাল গজারী ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপার লীলাভূমি গাজীপুর। বিল, ঝিল এবং সরকারি-বেসরকারি দুই শতাধিক রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট রয়েছে এ জেলায়। রাজধানীর সন্নিকটে থাকায় ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম পছন্দ এসব বিনোদন কেন্দ্র।
কিন্তু করোনাভাইরাসের থাবায় বিপর্যস্ত এখানকার রিসোর্ট ব্যবসা। দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস এসব বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় লোকসান গুনছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ২৫ হাজারের বেশি কর্মী। রিসোর্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, করোনাকালে দেশে এই খাতে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার আর্থিক লোকসান হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক খাতে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু পর্যটন খাতে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা। তবে জেলা প্রশাসন বলছেন, যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে রিসোর্ট পরিচালনা করতে চান, তারা আবেদন করলে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নিবন্ধিত ৭৬টিসহ রয়েছে আরও শতাধিক ছোট-বড় রিসোর্ট। করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে এসব রিসোর্টে জনসামগম নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসন। এরপর থেকে পুরো ছয় মাস ধরে বন্ধ এসব রিসোর্টের ব্যবসা।
আর্থিক লোকসানের মুখে রিসোর্ট ব্যবসা
জেলার সুকুন্দিবাগ এলাকার দৃষ্টিনন্দন রিসোর্ট 'ছুটি'। ৫০ বিঘা জমি নিয়ে প্রাকৃতিক বিল, ঝিল বেষ্টিত এই রিসোর্টে প্রতি মাসে অন্তত ৫০ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটত। গত মার্চ-এপ্রিল মাসে এই রিসোর্টের বুকিং ছিল চার কোটি টাকার। করোনাভাইরাস প্রকোপ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় দর্শনার্থীদের আনাগোনা। এতে ব্যাপক আর্থিক লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
ছুটি রিসোর্টের জমিদাতা অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা অনেক কষ্টে রিসোর্টের ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু করোনার জন্য এই ব্যবসা এখন হুমকির মুখে। এখানে বিদ্যুৎ বিল, কর্মীদের বেতনসহ বর্তমানে যে খরচ হচ্ছে, তা চালানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিচ্ছে, যদি রিসোর্ট ব্যবসায়ও প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে এই ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছি। অন্যথায় এই ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই রিসোর্টের ম্যানেজার আহসান কাদের বলেন, 'করোনাকালে দুটি ঈদ, পহেলা বৈশাখসহ যে মৌসুমী ব্যবসা ছিল, তা আমরা ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। এজন্য আমাদের উপার্জন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।'
'আমাদের যেখানে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আয় হতো, সেখানে এবার উপার্জন একেবারে শূন্য। এখানে আমাদের শতাধিক কর্মী রয়েছে। ব্যবসা না থাকায় অনেকের চাকরিচ্যূতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
কর্মীদের মানবেতর জীবন
সাত বছর ধরে এই রিসোর্টে কাজ করেন কবীর নামে এক কর্মী। রিসোর্ট থেকে বেতন পেয়ে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু করোনাকালে রিসোর্ট ব্যবসা বন্ধ থাকায় ছয় মাস ধরে বেতন ভাতা নিয়মিত পাচ্ছেন না তিনি। ফলে তাকে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
প্রণোদনা দাবি
গত মার্চ ও এপ্রিলে গাজীপুরের রাজাবাড়ী এলাকার সারাহ রিসোর্টে বুকিং ছিল দেড় কোটি টাকার বেশি। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর একের পর এক বুকিং বাতিল হতে থাকে। তবে বন্ধ থাকলেও একাধিক সুইমিংপুল, জিম, খেলাধুলার হরেক রকমের মাঠ, শিশু কর্নার, বোটিং ইত্যাদিসহ আধুনিক সব সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা রিসোর্টটির কর্মীদের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা।
দুরাবস্থার এ চিত্র শুধু ছুটি, সারাহ রিসোর্টের নয়; করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গাজীপুরের দুই শতাধিক রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট। মার্চ-এপ্রিল ছিল রিসোর্টের ভরা মৌসুম। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং দেশীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অনেক বুকিং ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রকোপের কারণে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা আসতে না পারায় মার্চের শুরু থেকেই বুকিং বাতিল হতে থাকে।
রিসোর্ট বন্ধ থাকায় এই খাতে প্রতিমাসে লোকসান হচ্ছে বলে দাবি এই খাতের ব্যবসায়ীদের। এজন্য সরকারের কাছে প্রণোদনাসহ অবিলম্বে রিসোর্ট ব্যবসা চালু করার দাবি করছেন তারা।
এ বিষয়ে ট্যুরিজম রিসোর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ শুধু পর্যটনের আয় দিয়ে চলছে। করোনাকালে এসব দেশে পর্যটনখাতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। গাজীপুরের দুই শতাধিক রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পটসহ সারা দেশে এই শিল্পে ৪০ হাজার কর্মী কাজ করেন। তাদের অধিকাংশ কর্মীই এখন বেকার।
তিনি বলেন, রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট মালিকরা ভর্তুকি দিয়ে টিকে আছেন। বিদ্যুৎ বিলসহ নানা ব্যয় রয়েছে। করোনাকালে এই খাতে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারকে প্রণোদনা প্রদানসহ উদ্যোগী হতে হবে বলেও জানান তিনি।
অভিন্ন চিত্র সরকারি বিনোদন কেন্দ্রেও
শুধু বেসরকারি রিসোর্ট, পিকনিক স্পট এই করোনায় বিপর্যস্ত হয়নি; ধস নেমেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানেও। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যেত। কিন্তু করোনায় এসব প্রতিষ্ঠানে বইছে সুনশান নীরবতা। নেই পর্যটকদের কোলাহল, টিকিট বিক্রির ধুুম।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক তবিবুর রহমান বলেন, 'মার্চ মাসের ২০ তারিখ থেকে পার্কটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে বন্ধ রয়েছে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের আনাগোনা। গত বছরে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এখানে দর্শনার্থী এসেছিলেন সাড়ে পাঁচ লাখ এবং রাজস্ব আহরণ করেছিলাম প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এই বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত দর্শনার্থী না থাকায় কোনো রাজস্ব আহরণ হয়নি।'
এ ছাড়া পার্কের আশপাশে পার্ককে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেছে; ইজারাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ইজারাদারদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাদের ইজারার মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, 'স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যদি কেউ ব্যবসা চালাতে পারেন। সেভাবে কেউ আবেদন করলে আমরা তাদেরকে অনুমোদন দিচ্ছি। এক্ষেত্রে লিখিতভাবে আবেদন করলে ধীরে ধীরে আমরা এসব রিসোর্ট খুলে দেওয়া হবে।'
'তবে প্রণোদনার বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা যদি বিষয়টি আমাদের জানায় তবে তা সরকারের উচ্চ মহলের নজরে আনতে পারব,' বলেন তিনি।