পিকাসো, আমার বাবা: 'গোপন' কন্যার স্মৃতি নিয়ে বই
১৯২৭ সালে প্যারিসের একটি গ্যালারির বাইরে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেমে যখন হাবুডুবু খাচ্ছেন কিংবদন্তি শিল্পী পাবলো পিকাসো, তখনও তিনি আইনত প্রাক্তন ব্যালেরিনা অল্গা খোখলোভার স্বামী।
সহসাই মারি-থেরেসা ওয়াল্টার নামের ওই কিশোরী হয়ে উঠলেন নিজের চেয়ে ২৮ বছর বড় চিত্রশিল্পীর দারুণসব পোর্ট্রেটের বিষয়বস্তু। পিকাসো নিজের আরও অনেকগুলো সম্পর্কের মধ্যে পরবর্তীজন, পরাবাস্তববাদী ফটোগ্রাফার ও পেন্টার ডোরা মারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে মারি-থেরেসার গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা।
সেই কন্যা, মায়া রুজ-পিকাসোর বয়স এখন ৮৪। এতকাল পরে বাবার জীবন ও বাবার সঙ্গে নিজের নিবিড় সম্পর্ক তিনি প্রাণ খুলে বলেছেন। আর সেই গল্প নিয়েই নতুন একটি বই সম্পাদনা করেছেন মায়ারই কন্যা, শিল্প-ইতিহাসবিদ ডায়ানা উইন্ডমায়ার-পিকাসো।
'পিকাসো অ্যান্ড মায়া: ফাদার অ্যান্ড ডটার' নামে ওই বই প্রকাশ পাবে আগামি মাসে।
বইটি ঘিরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মায়া বলেন, 'মায়ের সঙ্গে যখন বাবার প্রথম দেখা হয়, আমার ধারণা, বাবা তখন ভাস্কর্যের জন্য এমন কোনো মডেলই খুঁজছিলেন- যার মধ্যে নারীত্বের পাশাপাশি এক ধরনের তাগড়া পুরুষালি ব্যাপারও থাকবে। আর এ কারণেই মাকে তিনি হরদম নিজের শিল্পকর্মে, বিশেষ করে ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।'
১৯৩১ সালে পিকাসোর আঁকা 'স্টিল লাইফ অন অ্যা পেডেস্টল টেবিল'-এও ফুটে রয়েছেন মারি-থেরেসা। মায়া বলেন, 'একটা স্টিল লাইফ ইমেজের মধ্য দিয়ে বাবা আমার মায়ের শারীরিক বাঁকগুলো, বিশেষ করে তার স্তনকে ফুলের রূপে, একইভাবে তার উজ্জ্বল সোনালি চুলগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। এই অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে মায়ের প্রতি বাবার অনুভূতির ভাষান্তর ঘটেছে।'
মারি-থেরেসার সঙ্গে পিকাসোর সম্পর্কের মতোই মায়ার পরিচয়ও শুরুর দিকে গোপন রাখা হয়েছিল। তার জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই ডোরার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পিকাসো।
মায়া মনে করেন, তার মা আর ডোরাকে ঘিরে একটা টানাপড়েনে পড়ে গিয়েছিলেন ওই স্প্যানিশ কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী। সেই টানাপড়েন ফুটে রয়েছে ১৯৩৭ সালে আঁকা তার 'মারি-থেরেসা উইথ রেড বেরেট উইথ পমপম' শিরোনামের পোর্ট্রেটে।
'মায়ের ছবি ড্রয়িং করতে, পেইন্টিংয়ে তাকে আঁকতে, ভাস্কর্যে তাকে ফুটিয়ে তুলতে, শিল্পকর্মে তাকে খোদাই করতে বাবার কখনোই ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু এই পেইন্টিংটাতে তিনি মা ও ডোরা মারের একটি কম্বিনেশন করেছেন। এটার চুল আর চোখগুলো আমার মায়ের; অন্যদিকে নাক ও টোন ডোরা মারের কথা মনে করিয়ে দেয়- যিনি বাবার জীবনে ১৯৩৬ সালে ঢুকেছিলেন, আমার জন্মের অল্প কিছুদিন পরই,' বলেন মায়া।
ধারণা করা হচ্ছে, মারি-থেরেসা ও পিকাসোর সম্পর্ক এমন ইতিবাচকভাবে ফুটিয়ে তোলায় এই বইকে ঘিরে ব্যাপক সমালোচনা হবে। কেননা, 'মিটু' আন্দোলনের জাগরণে, নারীদের প্রতি পিকাসোর আচরণকে নতুনভাবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি আর্ট গ্যালারির পরিচালক জ্যাক রেনোল্ডস ২০১৮ সালে পিকাসোকে 'নারীদের সঙ্গে তার যে ইতিহাস, সেই নিরিখে বিংশ শতকের জঘণ্যতম নিপীড়কদের একজন' হিসেবে অভিহিত করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, 'আমাদের কি তার কাজগুলো গ্যালারি থেকে বের করে দেওয়া উচিত নয়?'
মারি-থেরেসার সঙ্গে পিকাসোর সম্পর্ক নিয়ে লেখালেখি পড়ার প্রতিক্রিয়ায় নেটফ্লিক্স শো 'নেনেট'-এ কমেডিয়ান হান্না গ্যাডসবাই বলেছেন, "পিকাসো বলতেন, 'এটাই পারফেক্ট, সে তার প্রাইম বয়সে আর আমিও আমার প্রাইম বয়সে ছিলাম।' এ লেখা যখন পড়ি, আমার তখন সম্ভবত ১৭ বছর বয়স। ভাবতে পারেন, কী ভয়ঙ্কর কথা?"
এই নতুন বইয়ে মায়া তার বাবার শিল্পকর্মের জন্য ৭ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মডেল হিসেবে পোজ দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, "আমরা হয়তো টেবিলে বসে আছি। হুট করেই তিনি আমাকে কোনো একটা ভঙ্গিমায় বা অভিব্যক্তিতে একদম নিশ্চল হয়ে থাকতে বলতেন। তিনি বলতেন, 'একদম নড়বে না কিন্তু!' তারপর ছুটে গিয়ে কাগজ, পেন্সিল, বোর্ড কিংবা নোটবুক নিয়ে আসতেন।"
১৯৩৮ সালে আঁকা 'ফার্স্ট স্নো' পোর্ট্রেটটি সম্পর্কে মায়া বলেন, 'সেদিনই আমি প্রথমবার হাঁটতে শিখেছিলাম... আমার পায়ে ছিল একজোড়া ছোট্ট গোলাপি বুটিস, যেগুলো বাবা তার কাছে সারাজীবন রেখে দিয়েছিলেন।'
পোজ দেওয়ার স্মৃতিচারণে মায়া আরও জানান, 'কিছুতেই যেন হেসে না ফেলি', সে জন্য বাচ্চা মেয়েটার ওপর চাপ দিতেন পিকাসো। তবে তার বাবার রসবোধ ছিল দারুণ এবং যুদ্ধের কালে বাবা তাকে খেলনা বানিয়ে দিয়েছেন, এসবও মনে পড়ে পিকাসো-কন্যার।
১৯৭৭ সালে, পিকাসোর মৃত্যুর ৪ বছর পর, ৬৮ বছর বয়সে আত্মহনন করেন মায়ার মা- মারি-থেরেসা ওয়াল্টার।
- সূত্র: গার্ডিয়ান